রতন ব্যাপারটা দেখানোর জন্য ডাকল, “কালাচান” সাথে সাথে একটা বাচ্চা তার পাখা নেড়ে মাথা ঝাঁকিয়ে সাড়া দিল। তারপর ডাকল, “ধলাচান” তখন অন্যটা পাখা নেড়ে মাথা ঝাঁকিয়ে সাড়া দিল।
মানিক হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, “কী ভয়ানক! তুমি কি কালা আর ধলা শব্দের মানে জানো না? কালা মানে কালো, ধলা মানে সাদা। এর মাঝে সাদা কাক কি আছে? তাহলে সাদা নাম কেন দিলে?
রতন বলল, “আমি কি আসলেই রতন? তুমি কি আসলেই মানিক? কিন্তু আমাদের নাম রতন আর মানিক। তাতে কার কী সমস্যা হয়েছে?”
মানিক বলল, “তাই বলে কালো আর ধলার মতো এরকম অমার্জিত শব্দ?”
রতন উত্তর না দিয়ে কালাচান আর ধলাচানকে আদর করতে লাগল। শব্দ কেমন করে অমার্জিত হয় সেটা সে বোঝে না।
.
এর মাঝে একদিন মিঠু, যাকে তার ক্লাশের ছেলেমেয়েরা মৃত্যু বলে ডাকে, কাকের বাচ্চা দুটো দেখতে এল। সে অবশ্যি একা আসেনি। তার সাথে আরো দুইজন এসেছে, চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে তাদের নাম মৃত্যু না হলেও গজব কিংবা তাণ্ডব হওয়ারই কথা। কাকের বাচ্চার যে জিনিসগুলো মানিক অপছন্দ করেছিল মিঠু আর তার বন্ধুরা সে জিনিসগুলোই পছন্দ। করল। কালাচান এবং ধলাচান নাম দুটো তাদের খুবই পছন্দ হলো, হাতে কিল দিয়ে মিঠু বলল, “ফাটাফাটি নাম! হুশ!”
ছোটো ছোটো রবোটিক হাত দেখে তারা মুগ্ধ হয়ে গেল। বলল, “ফ্যান্টাস্টিক! এক্কেবারে বুংগাবুংগি। হুশ! হুশ!
রতন বুংগাবুংগি শব্দটা আগে কোনোদিন শোনেনি, তাই তার মানে বুঝতে পারল না। কিন্তু অনুমান করল এটাও ফাটাফাটি’ অর্থ বোঝানোর জন্যে তৈরি করা একটা শব্দ হবে।
মিঠু জিজ্ঞেস করল, “কালাচান ধলাচান কি রবোটিক হাত নাড়াতে পারে?”
“এখনো হাত নাড়ানোর ট্রেনিং দেই নাই। প্রথমে অন্য ট্রেনিং দিচ্ছি।”
“কী ট্রেনিং?”
“টয়লেট ট্রেনিং।”
মিঠু এবং তার দুই বন্ধু অবাক হয়ে বলল, “টয়লেট ট্রেনিং?”
রতন মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ। পাখিদের নিয়ে কাজ করার এই হচ্ছে সমস্যা। যখন তখন বাথরুম করে দেয়। এ জন্যে কালাচান আর ধলাচানকে ট্রেনিং দিচ্ছি। যখন তখন বাথরুম করবে না। যখন বলবে তখন করবে।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ। ট্রেনিং মোটামুটি কমপ্লিট। এখনো মাঝে মাঝে একসিডেন্ট হয়ে যাচ্ছে কিন্তু সেটা তো হবেই। মানুষেরই হয় এরা তো কাকের বাচ্চা।”
মিঠু বলল, “হুশ! কী রকম ট্রেনিং, দেখানো যাবে?”
“হ্যাঁ। এই দেখ।” বলে কালাচান আর ধলাচানকে ঘরের এক কোনায় নিয়ে গেল, সেখানে একটা ছোটো বাক্স তার ভেতরে খবরের কাগজ বিছানো। বাক্সের ওপর কালাচান আর ধলাচানকে ধরে বলল, “পিচিক।”
সাথে সাথে পিচিক করে একই সাথে কালাচান ধলাচান বাথরুম করল। সেটা দেখে মিঠু আর তার দুই বন্ধু আনন্দে হাততালি দিয়ে বলল, “ঝিংগা মিংগা।”
ঝিংগা মিংগা শব্দটাও রতন জানে না, ধরে নিল এটাও বুংগাবুংগি কিংবা ফাটাফাটির মতো কোনো শব্দ হবে। বোঝাই যাচ্ছে শব্দটা আনন্দ প্রকাশ করার শব্দ, শব্দটা কালাচানের ধলাচানের জন্যে একটু বেশি হয়ে গেল, ভয় পেয়ে তারা ওড়ার চেষ্টা করল, এখনো উড়তে শেখেনি। তাই ডানা ঝাঁপটে তারা নীচে এসে পড়ল। তারপর হাঁচড়পাঁচড় করে একটা কোনায় লুকানোর চেষ্টা করল।
রতন কালাচান ধলাচানকে আদর করে তুলে নিয়ে বলল, “আরে বোকা, এত অল্পে ভয় পেলে চলবে? এই দেশে থাকতে হলে আরো কতরকম শব্দ শুনতে হবে! তাই না মিঠু?”
মিঠু মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিকই বলেছেন। কিন্তু আপনার ট্রেনিংটা এক্কেবারে ফাটাফাটি। পিচিক বললেই বাথরুম–”
মিঠুর মুখে পিচিক শব্দটা শুনে আবার কালাচান ধলাচান বাথরুম করে দিল, রতন প্রস্তুত ছিল না বলে এবারে তার হাতের মাঝে!
মিঠু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “হায় হায়! আমি বুঝতে পারি নাই এই শব্দটা বললেই বাথরুম করে দেবে–”
রতন বলল, “কোনো সমস্যা নেই, এটা অনেকবার হয়েছে। আমার পরের প্রজেক্ট হচ্ছে পাখিদের জন্যে ডাইপার আবিষ্কার।”
কথাটা শুনে এই তিন রত্ন খুব মজা পেল। তারা খানিকক্ষণ হি হি করে হাসল। হাসি থামার পর তিনজনই হঠাৎ করে গম্ভীর হয়ে গেল, মিঠু বলল, “বুঝলি তোরা, এই কাকের বাচ্চা দিয়ে কী সাংঘাতিক কাজ করা। যাবে।”
“কী কাজ?”
“এটা যখন উড়ে উড়ে কারো মাথার ওপর আসবে তখন আমরা এই শব্দটা বলব আর সাথে সাথে তার মাথায় বাথরুম করে দেবে।”
দৃশ্যটা কল্পনা করে তিনজন আবার আনন্দে হি হি করে হাসতে থাকে। অনেক কষ্ট করে হাসি থামিয়ে মিঠু বলল, “সবার আগে মোখলেস স্যারের মাথায়।”
“তারপর বিলকিস মিস।”
“তারপর শাহজাহান স্যার।”
“তারপর কুদ্স স্যার।”
“তারপর জাহানারা ম্যাডাম।”
একেকজন স্যার কিংবা ম্যাডামের নাম বলে আর তারা হেসে গড়াগড়ি খেতে থাকে, রতন এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। ব্যাপারটা কল্পনা করেই তাদের এত আনন্দ সত্যি সত্যি করতে পারলে না জানি কী হবে!
.
এর কয়েকদিন পর রতন কালাচান আর ধলাচানের রবোটিক হাতের সার্কিট প্রথমবারের মতো অন করল। তখন যা একটা ভয়ংকর ব্যাপার হলো তা বলার মতো না। হাত দুটি পুরোপুরি অনিয়ন্ত্রিতভাবে সামনে পিছনে ডানে বাঁয়ে নড়তে থাকে। হাতের আঙুল খুলতে থাকে বন্ধ হতে থাকে আর কাকের বাচ্চা দুটি ভয় পেয়ে ঝাপাঝাপি শুরু করে দেয়। রতনকে তাই একটু পরেই সার্কিটের সুইচটা আবার বন্ধ করে দিতে হলো।