মানিক অশুদ্ধ ভাষা সহ্য করতেই পারে না প্রায় বলেই ফেলছিল “শব্দটা লামেন নয় শব্দটা নামেন এবং হলে নয়–শব্দটা হচ্ছে সকলে” কিন্তু শেষ পর্যন্ত থেমে গেল কারণ সে দেখতে পেল প্যাসেঞ্জার এবং বাসের হেলপার আর কনডাক্টরের মাঝে একটু উত্তেজনার মতো ভাব হয়েছে। মানিক বাস থেকে নেমে জানতে পারল এই বাসটি আর যাবে না, সবাইকে নেমে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মুড়িরটিন মার্কা লক্কর-ঝক্কর বাসটিতে উঠতে হবে। সেই বাসটি শুধু যে মুড়ির টিন তাই নয় তার রং ক্যাটক্যাটে বেগুনি এবং দগদগে হলুদ। কাছে গিয়ে মানিক দেখল, ড্রাইভারের চেহারা ডাকাতের মতো, গলায় সোনার চেন, চোখ লাল, দাঁত কালো। মানিককে দেখে ড্রাইভার বলল, “উঠেন উঠেন, তাড়াতাড়ি ওঠেন। আরো দুই ট্রিপ মারতে হবে।”
মানিক মুখ শক্ত করে বলল, “আমি আপনার বাসে উঠব না।” ড্রাইভার তার কালো দাঁত বের করে হাসল, মানিক দেখল ড্রাইভারের শুধু যে দাঁত কালো তা নয় জিবটিও কালো। বলল, “না উঠে আপনার কুনো উপায় নাই। সব প্যাসেঞ্জারদের আমাদের কাছে বিক্রি করেছে।”
“বিক্রি করেছে? প্যাসেঞ্জার বিক্রি হয়?”
“জে বিক্রি হয়। পাইকারি খুচরা দুই রকমই বিক্রি হয়।”
ড্রাইভারের কথা শুনে মানিকের প্রথমবার একটুখানি রাগ উঠে গেল–রেগে গেলে তার কথায় কঠিন কঠিন শব্দ চলে আসে তাই সে বলল, “কিন্তু এটি গ্রহণযোগ্য নয়। এটি মানবাধিকার পরিপন্থী কুরুচিপূর্ণ নিয়ম বহির্ভূত কাজ–”
ড্রাইভার মানিকের কঠিন কঠিন শব্দগুলো না বুঝে মনে করল তাকে। বুঝি গালাগাল করা হচ্ছে তাই সে চোখ পাকিয়ে বলল, “কী বললেন আপনি?”
মানিকের মনে হলো এখন তার এখানে থাকা ঠিক হবে না তাই সে সরে আগের বাসের কাছে চলে এল। তার ধারণা ছিল গিয়ে দেখবে। প্যাসেঞ্জাররা বুঝি ততক্ষণে আরো খেপে উঠেছে, কিন্তু দেখল, ঠিক তার। উলটো, প্যাসেঞ্জাররা নরম হয়ে নিজেদের জিনিসপত্র নামিয়ে লক্কর-ঝক্কর মুড়িরটিন বাসে উঠতে শুরু করেছে। কারণটাও সে অনুমান করতে পারল, বাসের ড্রাইভারের হাতে একটা লোহার রড, হেলপার আর কন্ডাক্টরের হাতে দুইটা চ্যালা কাঠ। শুধু তাই নয়, আশেপাশে আরো কয়েকজন মানুষ নানা সাইজের গাছের ডাল নিয়ে ঘুরোঘুরি করছে।
অন্যেরা ভয় পেতে পারে কিন্তু মানিক কবি মানুষ তাকে তো ভয় পেলে চলবে না। সে গিয়ে গম্ভীর গলায় ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল, “ড্রাইভার সাহেব কাজটা কি ঠিক হলো?”
ড্রাইভার ভুরু কুঁচকে বলল, “কোন কাজটা বেঠিক হয়েছে?”
এই ড্রাইভারের সম্রান্ত চেহারা দেখে মানিক বাসে উঠেছিল এখন এই ড্রাইভারকেই কেমন যেন সন্ত্রাসী সন্ত্রাসী দেখাতে থাকে। মানিক ঢোক গিলে বলল, “এই যে আমাদের সবাইকে বিক্রি করে দিলেন? আমি আপনাদের সুন্দর বাসে উঠেছিলাম–ঐ ভাঙাচোরা বাসে আমি উঠব না।”
ড্রাইভার তার হাতের লোহার রড হাত বদল করে বলল, “কিন্তু আমি তো আমার সুন্দর বাস নিয়া ঐ লাইনে যাইতে পারুম না। গতকাল একটা এসকিডেন্ট হলো।
মানিক প্রায় বলেই ফেলছিল “শব্দটা এসকিডেন্ট নয়, শব্দটা এক্সিডেন্ট” অনেক কষ্ট করে নিজেকে থামাল।
হেলপার তার চ্যালাকাঠ নিয়ে এগিয়ে আসে, “পত্রিকায় দেখেন নাই? একটা টেম্পু ফিনিস?” তার চোখমুখ ভালো একটা এক্সিডেন্ট করার গর্বে ঝলমল করতে থাকে।
ড্রাইভার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “এখন ঐ লাইনে গেলে আমার খবর আছে। দুই চারদিন যাক, অবস্থা ঠান্ডা হোক।”
মানিক মুখ শক্ত করে বলল, “কিন্তু আমি ঐ উৎকট বেগুনি হলুদ রঙের বাসে উঠব না। কিছুতেই উঠব না।”
“না উঠলে নাই। কোম্পানির পলিসি প্যাসেঞ্জারদের জায়গা মতন পৌঁছায়া দেওয়া কিন্তু ভাড়া ফেরত দেওয়ার নিয়ম নাই।”
মানিক গম্ভীর গলায় বলল, “আমি মোটেও ভাড়া ফেরত দিতে বলিনি। আমি শুধু আপনাদের কাছে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে প্রতিবাদ। করলাম।” কথা শেষ করে মানিক চলে এল, সে দেখতে পেল না যে বাসের ড্রাইভার হেলপার আর কন্ডাক্টরের হাত দিয়ে মাথার মাঝে ইঙ্গিত করে একে অন্যকে বোঝাল যে মানিকের মাথায় গোলমাল আছে। তারপর তিনজন মিলে আনন্দে হা হা করে হাসল সেটাও মানিক দেখতে পেল না।
.
বাস দুটো ছেড়ে দেবার পর মানিকের মনে হলো কাজটা বোধ হয় ঠিক হলো না, কষ্ট করে হলেও লালচোখ কালো দাঁত ড্রাইভারের লক্কর-ঝক্কর হলুদ বেগুনি বাসে চলে যাওয়া উচিত ছিল। যেখানে তাদের নামিয়েছে। তার আশেপাশে কিছু নেই, শুধু রাস্তা দিয়ে মাঝে মধ্যে হুশহাশ করে একটা দুইটা বাস ট্রাক গাড়ি চলে যাচ্ছে। মানিক তখন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাঁটতে শুরু করে, আর কিছু না হোক হাঁটতে হাঁটতে ঘুংচির বদলে। একটা অন্য শব্দ নিশ্চয়ই বের হয়ে যাবে।
ঠিক যখন ঘুংচি শব্দটার একটা ভালো প্রতিশব্দ মাথায় প্রায় চলে আসছিল তখন কোথা থেকে একটা গাড়ি হুশ করে এসে ঠিক তার সামনে দাঁড়িয়ে গেল। গাড়িটার মাঝে কিছু-একটা অন্যরকম ব্যাপার আছে যেটা সে ঠিক ধরতে পারল না। গাড়িটা ছোটো এবং পুরানো রং-ওঠা এবং বিবর্ণ। হঠাৎ দেখলে মনে হয় বুঝি একটা বড়ো সাইজের খেলনা গাড়ি। গাড়িটা ছোটো হলেও সেটা বিকট শব্দ করে এবং পিছন থেকে গলগল করে কুচকুচে কালো ধোঁয়া বের হয়। গাড়িটা কয়েকবার ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল আর তখন ভেতর থেকে উশকোখুশকো চুলের একজন মানুষ। বের হয়ে এলো। মানুষটার গায়ের রং ফর্সা এবং নাকের নীচে ঝাঁটার মতো গোঁফ। মানিক দুই চোখে গোঁফ দেখতে পারে না, তার অনেকদিন থেকে ইচ্ছা সে গোঁফওয়ালা কোনো মানুষকে জিজ্ঞেস করবে সর্দি হলে তারা কেমন করে নাক ঝাড়ে, নাকের নীচে গোঁফগুলো কোনো ঝামেলা তৈরি করে কি না।