রতন বলল, “তুমি ঠিক অনুমান করেছ।”
“আমি এখনো পুরোটুকু অনুমান করতে পারিনি। ছোটো ছোটো হাত লাগাতে চাও ভালো, কিন্তু এই কুৎসিত বাচ্চাগুলোকে কেন? এত ছোটো। বাচ্চা নিজে খেতেই পারে না সে হাত দিয়ে কী করবে?”
“একবার বড়ো হয়ে গেলে সে আর হাত ব্যবহার করতে পারবে না। ছোটো থাকতে চেষ্টা করলে সেটাকে অভ্যস্ত করানো যাবে।”
মানিক অনেকক্ষণ কথা না বলে চুপ করে রইল, তারপর ফোঁস করে। একটা বড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমি সবকিছু বুঝতে পেরেছি শুধু একটা জিনিস এখনো বুঝতে পারিনি।”
রতন জিজ্ঞেস করল, “কী?”
“পৃথিবীতে এত বিচিত্র পাখি রয়েছে, এত সুন্দর সুন্দর পাখি রয়েছে, সবকিছু ছেড়ে তুমি কাককে কেন বেছে নিলে? কালো কুৎসিত কদাকার কাক?”
রতন বলল, “তার কারণ পাখিদের মাঝে কাক হচ্ছে সবচেয়ে বুদ্ধিমান। কাকদের বলে পাখিদের আইনস্টাইন।”
“পাখিদের আইনস্টাইন?”
“হ্যাঁ।”
মানিক তখন আবার একটা লম্বা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, “পাখিদের যদি আইনস্টাইন থাকে তাহলে কি পাখিদের শেকসপিয়ার আছে?”
“নিশ্চয়ই আছে?”
“সেটি কোন পাখি?”
“আমি জানি না। প্যাচা হতে পারে।”
“প্যাঁচা? প্যাঁচা কেন হবে?”
রতন বলল, “কবি সাহিত্যিকদের কথা মনে হলেই আমার কেন জানি মনে হয় একজন মুখ ভোঁতা করে বসে আছে, অনেকটা প্যাচার মতো।”
মানিক চোখ গরম করে রতনের দিকে তাকাল, বলল, “তুমি অত্যন্ত অশোভন একটা কথা বলেছ।”
রতন মাথা নাড়ল, বলল, “আমার যেটা মনে হয় সেটা বলেছি। আমি কী করব? আগে শুধু একটা ভাসা-ভাসা ধারণা ছিল তোমাকে দেখে ধারণাটা পাকা হয়েছে।”
মানিক মুখটা প্যাঁচার মতো করে বসে রইল। রতন গভীর মনোযোগ দিয়ে কাকের বাচ্চা দুটোকে খাওয়াতে লাগল।
.
কাকের বাচ্চা দুটির ডানায় রবোটিক হাত লাগানোর কাজটা মোটেও সহজ হলো না। বাচ্চা দুটি খুবই বিরক্ত হলো এবং যতবার দুটো হাত লাগানো হলো ততবার সেগুলো খুঁটে খুঁটে খুলে ফেলার চেষ্টা করতে লাগল। রতন হাল ছাড়ল না, সে অনেকভাবে চেষ্টা করে হাতগুলো লাগিয়ে যেতে লাগল। রতনের ধৈর্যের শেষ নেই তাই কাকের বাচ্চা শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিল এবং দেখা গেল তাদের দুই ডানা থেকে ছোটো ছোটো দুটো হাত লম্বা হয়ে বের হয়ে এসেছে। সেখানে এখনো কোনো কানেকশান দেয়া হয়নি, রতন প্রথমে কাকের বাচ্চাগুলোকে তাদের রবোটিক হাতে অভ্যস্ত করতে চায়। যখন অভ্যস্ত হয়ে যাবে তখন হাত দুটোকে চালু করা যাবে।
মানিক যখন দেখতে এলো তখন কাকের বাচ্চা দুটি তাদের বাড়তি হাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ডানা থেকে দুটি হাত সোজা সামনের দিকে বের হয়ে এসেছে। যখন কানেকশান দেয়া হবে তখন সেগুলো ভাজ হবে, নড়বে–এই মুহূর্তে সেগুলো দুটো ছোটো ছোটো কাঠি ছাড়া আর কিছু নয়।
এর মাঝে রতন কাকের বাচ্চা দুটির জন্যে থাকার জায়গা করেছে। তার বাসার পিছনে খোলা জায়গাটা সে নেট দিয়ে ঘিরে দিয়েছে। ভেতরে কয়েকটা গাছও আছে। সেরকম একটা গাছে সে একটা বাক্স বসিয়ে তাদের বাসা তৈরি করেছে। ভিতরে কাঠকুটো দিয়ে তৈরি কাকের বাসা। বাচ্চা দুটো সেখানে থাকতে আপত্তি করে না। রতন ঘড়ি ধরে বাচ্চাগুলোকে খাওয়ায়। বাচ্চাগুলো এখন রতনকে দেখলেই মুখ হা করে তার দিকে এগিয়ে আসে, রতন আদর করে খাইয়ে দেয়। কাকের বাচ্চা দুটোর গায়ে ছোটো ছোটো কালো পালক উঠতে শুরু করেছে সেই ল্যাদল্যাদা পালকছেঁড়া ভাবটা আর নেই। বাচ্চাগুলো রতনের গলার স্বরেও অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। ডাকলে তারা সাড়া দেয়। রতন বাচ্চা দুটোর নাম দিয়েছে কালাচান এবং ধলাচান। দেখতে দুটো একইরকম, রতন অবশ্যি আলাদা করতে পারে, চোখের রং গায়ের পালক আর পাখার গঠনে ছোটোখাটো পার্থক্য আছে যেটা রতন ছাড়া আর কারো চোখে ধরা পড়ে না।
মানিক কাকের বাচ্চা দুটির দিকে এক ধরনের বিতৃষ্ণা নিয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, “শুধু কাকের বাচ্চা দেখতে যথেষ্ট খারাপ। এখন এই দুটো ঘটঘটিক হাত লাগানোর পর এদের দেখতে আরো খারাপ লাগছে।”
রতন বলল, “শব্দটা ঘটঘটিক না। রবোটিক।”
“এক কথা। আমার কানে রবোটিক আর ঘটঘটিক আলাদা কোনো ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে না। আমার কাছে দুটিই এক।”
রতন কোনো উত্তর না দিয়ে কাকের বাচ্চা দুটোর কাছে গিয়ে ডাকল, “কালাচান, ধলাচান এদিকে আসো।”
রতনের ডাক শুনে দুটো বাচ্চাই হাঁচড়পাঁচড় করে তার দিকে এগিয়ে এসে, তার হাতে ওঠার চেষ্টা করতে থাকে। মানিক চোখ কপালে তুলে বলল, “কী বললে, কী বললে তুমি?”
রতন বলল, “আমি বাচ্চা দুটোকে ডাকলাম। একটার নাম কালাচান আরেকটা ধলাচান।”
“হায়, হায় হায়! তুমি এ কী করেছ? এরকম দুটো অমার্জিত শব্দ ব্যবহার করে নাম রেখেছ? নাম দেয়ার আগে তুমি আমাকে কেন জিজ্ঞেস করলে না? এদের নাম হতে পারত কৃষ্ণকলি, একটা কৃষ্ণ আরেকটা কলি।”
রতন তার হাতের উপর উঠে বসে থাকা বাচ্চা দুটোকে আদর করতে করতে বলল, “আমি বুঝতে পারিনি তুমি এদের নাম দিতে চাইবে। আমি ভেবেছিলাম তুমি এদের দুইচোখে দেখতে পার না।”
মানিক বলল, “অবশ্যই দুই চোখে দেখতে পারি না। তাই বলে দুটো সুন্দর নাম দিতে আপত্তি করব কে বলেছে?”
রতন ব্যাপারটা উড়িয়ে দিয়ে বলল, “ছেড়ে দাও! আমার তো কালাচান আর ধলাচান নাম দুটো ভালোই লাগছে। ডাকলে কি সুন্দর সাড়া দেয় দেখেছ?”