ছেলেটার সিনেমা নিয়ে খুব আগ্রহ আছে বলে মনে হলো না, জিজ্ঞেস করল, “কাকের বাচ্চা দিয়ে কী করবেন?”
“পাখি নিয়ে আমার একটা থিওরি আছে সেটা সত্যি কি না টেস্ট করব।”
ছেলেটার চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল, “আপনি সাইন্টিস্ট?”
“বলতে পারো!”
“আপনি গবেষণা করেন? আপনার ল্যাবরেটরি আছে?”
“মোটামুটি একটা আছে।”
ছেলেটার চোখ আরো বড়ো বড়ো হয়ে গেল, বলল, “হুশ!”
রতন বলল, “তোমার কাকের বাচ্চার জন্যে কত দিতে হবে? বেশ কয়েকটা সায়েন্স ফিকশানের বই যেন নিতে পার সেরকম দিলে কি হবে?”
ছেলেটা বলল, “আপনাকে টাকা দিতে হবে না। আমি আগে কখনো সাইন্টিস্ট দেখি নাই। আজকে দেখলাম। বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্যে আপনাকে আমি ফ্রি কাকের বাচ্চা দিয়ে গেলাম।”
“সে কী!”
“হ্যাঁ। ফ্রি! গবেষণার জন্য আর কী লাগবে বলেন। সেগুলাও দিয়ে যাব।”
“আপাতত কিছু লাগবে না। কিন্তু তোমার ফ্রি কাকের বাচ্চা দিতে হবে না।” রতন তখন তাড়াতাড়ি একটা খামে কয়েকটা বড়ো বড়ো নোট ভরে ছেলেটির হাতে ধরিয়ে দিল। ছেলেটার জীবনের প্রথম উপার্জন এটা, তার মনে রাখার মতো হলেই ভালো। ছেলেটা খামটা হাতে নিয়ে বলল, “হুশ!”
“তোমার নামটা কী?”
“মিঠু। বন্ধুরা ডাকে–” ছেলেটা কথা শেষ না করে থেমে গেল।
“বন্ধুরা কী ডকে?”
“মৃত্যু।”
“মৃত্যু? কী সর্বনাশ! তোমাকে মৃত্যু ডাকে কেন?”
“আমাকে ভয় পায় তো সেই জন্যে?”
“তোমাকে ভয় পায় কেন?”
“কী জানি!” ছেলেটা এই আলাপটা চালিয়ে যেতে বেশি উৎসাহ দেখাল না। কিন্তু রতন অনুমান করতে পারল। যে ছেলে হাজার হাজার কাকের আক্রমণকে পরোয়া না করে কাকের বাসা থেকে তার বাচ্চা ছিনতাই করে নিয়ে আসতে পারে তাকে মনে হয় একটু ভয় পাওয়াই যেতে পারে।
খামটা হাতে নিয়ে চলে যেতে যেতে ছেলেটা থেমে গেল, ফিরে এসে বলল, “আমি কি মাঝে মাঝে এসে এই কাকের বাচ্চাকে দেখে যেতে পারব?”
রতন বলল, “অবশ্যই! যখন ইচ্ছা। তুমি যদি চাও তাহলে তোমার বাসার টেলিফোন নম্বর দিয়ে যেতে পার। দেখানোর মতো কিছু হলে তোমাকে ফোন করে আমি খবর দিয়ে দিব।”
মিঠু খানিকক্ষণ কিছু-একটা চিন্তা করে বলল, “আব্বুর টেলিফোন নম্বর দিয়ে লাভ নাই, উলটো ধরে আমাকে পিটুনি দিবে। আম্মুর নম্বর দিয়েও লাভ নেই, ফোনটাই ধরবে না। আপুর নম্বরটা দিতে পারি। মেজাজ ভালো থাকলে আমাকে ফোন দিতেও পারে।”
“ঠিক আছে, তাহলে তোমার বোনের নম্বরটাই দিয়ে যাও।”
মিঠু রতনকে তার বোনের টেলিফোন নম্বরটা দিয়ে গেল।
.
মানিক কাকের বাচ্চা দুটিকে দেখল একদিন পর। রতন টেবিলের উপর বাচ্চা দুটোকে রেখে একটা সিরিঞ্জ দিয়ে খাবার খাওয়াচ্ছিল, মানিক দেখে চিৎকার শুরু করল, “কী? এগুলো কী?”
রতন বলল, “কাকের বাচ্চা।”
“কাকের বাচ্চা এরকম কেন? এদের পালক কে ছিঁড়েছে?”
“কেউ ছিঁড়েনি। এদের পালক এখনো গজায়নি।”
“কী কুৎসিত! দেখে মনে হচ্ছে কেউ এদের ন্যাংটো করে রেখেছে!”
রতন একটা কাকের বাচ্চার মুখে সিরিঞ্জটা ধরে চাপ দিয়ে খানিকটা খাবার ঢুকিয়ে দিতেই বাচ্চাটা আগ্রহ নিয়ে সেটা খেতে থাকে। দ্বিতীয় বাচ্চাটা তখন মুখ হা করে এগিয়ে আসে।
মানিক বলল, “শুধু কুৎসিত নয়। এগুলো নির্লজ্জের মতো ক্ষুধার্ত এবং লোভী। এদের খাওয়ার মাঝে কোনো সৌন্দর্য নেই।”
রতন বলল, “খাওয়ার মাঝে যে সৌন্দর্য থাকে আমি জানতাম না।”
মানিক বলল, “এই বাচ্চা দুটি যে শুধু কুৎসিত তাই নয় এরা যখন খাচ্ছে তখন বাথরুম করছে। ইয়াক থু, ছিঃ।”
রতন বলল, “তোমার মা বেঁচে থাকলে আমি তার সাথে দেখা করে জিজ্ঞেস করতাম, যখন তুমি খুব ছোটো ছিলে তখন তুমিও খাওয়ার সময় বাথরুম করতে কি না।”
মানিক কথাটা না শোনার ভান করে বলল, এতকিছু থাকতে তুমি কেন দুটি কাকের বাচ্চার পিছনে এত সময় দিচ্ছ?”
“পাখি নিয়ে আমার একটা থিওরি আছে, আমি সেটা টেস্ট করব।”
“সেটি কী?”
“তুমি নিশ্চয়ই জান পাখিরা খুব বুদ্ধিমান।”
মানিক মাথা নাড়ল, বলল, “আমি জানি না।”
“ঠিক আছে না জানলেও সমস্যা নেই। এখন জানলে। বুদ্ধিমান প্রাণী তাদের হাত দিয়ে অনেক কিছু করে। পাখিদের হাত নেই, যে দুটো অংশ হাত হতে পারত সেগুলো হয়ে গেছে পাখা। কাজেই আমরা যে কাজগুলো হাত দিয়ে করি, পাখিদের সেগুলো করতে হয় ঠোঁট দিয়ে।”
“তাতে সমস্যাটা কী?”
“কোনো সমস্যা নেই। শুধু একদিন হাত ব্যবহার না করে মুখ দিয়ে জুতার ফিতা বাঁধার চেষ্টা কর।”
“আমি কেন মুখ দিয়ে জুতার ফিতে বাঁধব?”
“ঠিক আছে বাঁধতে না চাইলে বেঁধো না। কিন্তু যদি বাঁধতে চেষ্টা করতে তাহলে বুঝতে পারতে মুখের তুলনায় হাত দিয়ে কাজ করা কত সহজ! হাত দিয়ে কাজ করতে পারলে তুমি অনেক কিছু করতে পারো, হাত না থাকলে তুমি কিছুই পারো না।”
“আমি এখনো বুঝতে পারছি না তুমি কী বলতে চাইছ।”
“তার কারণ আমি যেটা বলতে চাইছি সেটা এখনো বলিনি। এখন বলি, তুমি শোনো। পাখিরা অনেক বুদ্ধিমান হলেও তারা কিছুই করতে পারে না, কারণ তাদের হাত নেই। তাদের যদি হাত থাকত তাহলে তারা
জানি কতো কিছু করতে পারত। সেজন্যে”
“সেজন্যে কী?”
“সেজন্যে আমি তাদের শরীরে দুটো ছোটো ছোটো রবোটিক হাত লাগিয়ে দিতে চাই। দেখতে চাই তখন তারা তাদের বুদ্ধি ব্যবহার করে সেই হাত দিয়ে কী করে।”
“তার মানে তুমি যে দুই মাস সময় লাগিয়ে পুতুলের দুইটা হাত তৈরি করেছ সেগুলো আসলে এই কাকের বাচ্চাদের জন্যে?”