কুকুরের ডাকে ম্যাজিকের মতো কাজ হলো। পুরান ঢাকার বিখ্যাত মাস্তান চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল। রতন আগেও দেখেছে ভারি গলায় কুকুরের ডাকের এই রেকর্ডিংটা সব সময়ে ম্যাজিকের মতো কাজ করে। সে এমনভাবে এটা রেডি করেছে যে, টাইগার বলে ডাকলেই রেকর্ডিংটা বেজে ওঠে। ডাকটা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। মনে হয় ভেতর থেকে বাইরে ছুটে আসছে।
কাকের বাচ্চা নিয়ে দ্বিতীয় যে মানুষটি এলো সেও মহা ধুরন্ধর, সত্যি কথা বলতে কী সে পুরান ঢাকার মাস্তান থেকেও বড়ো ধুরন্ধর। সেও একটা মুরগির বাচ্চা নিয়ে এসেছে কিন্তু সে এনেছে কালো রং করে। রতন মুরগির বাচ্চাটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ সেটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “কাজটা ঠিক করেননি।”
মানুষটা কিছু বুঝতে পারেনি সেরকম ভান করে বলল, “কোন কাজটা?”
“এই যে মুরগির বাচ্চাকে আলকাতরা দিয়ে কালো রং করে নিয়ে চলে এসেছেন। এত ছোটো বাচ্চাটা তো এখন মরে যাবে।”
মানুষটা জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “উঁহু। এটা মোটেও আলকাতরার রং না, এটা পাকা রং।”
“পাকা হতে পারে কিন্তু আমি আলকাতরার গন্ধ পাচ্ছি। রংটা এখনো কাঁচা, হাত দিলে হাতে উঠে আসছে।”
মানুষটা তখন খুব অবাক হবার ভান করে বলল, “কী আশ্চর্য! এই জন্যে মানুষকে বিশ্বাস করতে নাই। আমি অফিসের স্টাফকে দায়িত্ব দিয়েছি, ব্যাটা যেন আমাকে কাকের বাচ্চা এনে দেয়, আর সে কী দিয়েছে দেখলেন? মুরগির বাচ্চাকে আলকাতরাতে চুবিয়ে দিয়ে দিয়েছে। ব্যাটা বদমাইস, আজকেই ব্যাটাকে তাড়িয়ে দেব! চাকরি নট করে দিব।”
রতন কোনো কথা না বলে মানুষটাকে আলকাতরা দিয়ে কালো রং করা মুরগির বাচ্চাটা ফিরিয়ে দিল। মানুষটা তার বাক্সে সেটা ভরে তাড়াতাড়ি বের হয়ে গেল। রতনের এবারে টাইগারকে ডাকতে হলো না।
এভাবে সারাদিনই নানা ধরনের মানুষ নানাকিছু নিয়ে আসতে লাগল। একজন একটা আধমরা কাক নিয়ে এসে বলল, এটা কাকের বাচ্চা, তার বাপ মা তাকে বেশি বেশি মরা ইঁদুর খাইয়ে তাড়াতাড়ি বড়ো করে ফেলেছে। একজন কয়েকটা ডিম নিয়ে এসে বলল, এটার ভিতরে কাকের বাচ্চা আছে। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবে। (রতন টেবিলে ডিমটাকে দুই পাক দিয়ে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, ভেতরে বাচ্চা নেই, বাচ্চা থাকলে মোমেন্ট অফ ইনারশিয়ার কারণে ভিন্ন এংগুলার মোমেন্টাম হতো কিছু না বুঝে লোকটা মুখ কালো করে ফেরত গেল) একজন কয়েকটা কালো কবুতরের বাচ্চা কাকের বাচ্চা হিসেবে গছিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল।
সত্যিকারের কাকের বাচ্চা নিয়ে এলো দশ বারো বছরের একটা ছেলে। ছেলেটার জ্বলজ্বলে চোখ উশকোখুশকো চুল এবং সারা শরীরে অসংখ্য কাটাছেঁড়া। পলিথিনের ব্যাগে দুইটা কাকের বাচ্চা রতনের সামনে রেখে বলল, “হুশ!”
হুশ মানে কী কিংবা কেন বলা হয় রতন জানে না, তাই সেটা নিয়ে মাথা ঘামাল না। বাচ্চাটাকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার কী হয়েছে? শরীরে এত কাটাছেঁড়া, ছাল ওঠা কেন?”
“বদমাইস কাকগুলি এটাক করেছিল। যখন কাকের বাচ্চা নিচ্ছিলাম তখন হাজার হাজার কাক এসে আমাকে আক্রমণ করেছে।”
রতন সত্যি সত্যি একটু ভয় পেয়ে বলল, “সর্বনাশ!”
“চারটা বাচ্চা ছিল। দুইটা রেখে এসেছি কাকের ফেমিলির জন্যে। বদমাইশগুলি জানে না ছোটো পরিবার সুখী পরিবার।”
“তুমি ব্যথা পাওনি তো?”
“পাই নাই আবার। কাকের ঠোঁট কী ভয়ংকর জানেন?”
“তুমি এত ছোটো ছেলে এরকম একটা ডেঞ্জারাস কাজ করতে গেলে! কাকেরা খুব দল বেঁধে থাকে।”
ছেলেটা প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, “হুশ!”
রতন পলিথিনের ব্যাগ থেকে কাকের দুইটা বাচ্চা বের করে টেবিলে রাখল। শরীরে কোনো পালক নেই, মনে হয় রোস্ট করার জন্যে কেউ ছোটো ছোটো মোরগের বাচ্চার পালক তুলে ফেলেছে। কাকের বাচ্চা দুটি একটা আরেকটার সাথে জড়াজড়ি করে মুখ হা করে নড়তে লাগল।
রতন বলল, “ফ্যান্টাস্টিক! কোথায় পেলে বাচ্চাগুলো?”
“আমাদের ফ্ল্যাট চারতলায়, পাশে বাড়িওয়ালার আম গাছ আছে। সেই আম গাছে কাক বাসা করে ডিম পেড়েছে। আমাদের ফ্ল্যাট থেকে দেখা যায়। কালকে মাত্র ডিম থেকে বাচ্চা বের হয়েছে।”
“ভেরি গুড।” ছোটো ছেলেমেয়েদের সাথে কীভাবে কথা চালিয়ে যেতে হয় রতনের জানা নেই, তাই কী বলবে বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, “তুমি বুঝি পত্রিকায় বিজ্ঞাপনটা দেখেছিলে?”
বাচ্চাটা মাথা নাড়ল, বলল, “সেটা অনেক লম্বা স্টোরি।”
“লম্বা স্টোরি?”
“হ্যাঁ। হুশ!”
“কী স্টোরি?”
“ফাটাফাটি একটা সায়েন্স ফিকশানের বই বের হয়েছে। আব্বুকে কিনে দিতে বললাম। আব্বু কানে ধরে একটা চটকানি দিয়ে বলল, পাঠ্যবই বাদ দিয়ে আউট বই পড়বে! নো মোর আউটবুক। যেদিন নিজে পয়সা কামাই করবি সেইদিন নিজের পয়সা দিয়ে আউটবুক কিনবি।”
ছেলেটা একটু থামল, রতন জিজ্ঞেস করল, “তারপর?”
“তখন নিজে কীভাবে পয়সা কামাই করা যায় সেইটা দেখার জন্যে পত্রিকাটা ঘাটাঘাটি করলাম। তখন বিজ্ঞাপনটা দেখেছি।” ছেলেটার মুখে এগাল-গাল জোড়া হাসি ফুটে উঠল, বলল “আমার জন্যে এক্কেবারে। মিলে গেছে। শুধু বদমাইশ কাকের গুষ্টি কাকগুলো বড়ো ঝামেলা করেছে।”
রতন মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। দল বেঁধে কাক যখন এটাক করে সেটা খুব ডেঞ্জারাস। আলফ্রেড হিচককের এরকম একটা সিনেমা আছে, নাম দি বার্ডস।”