রতন ইতস্তত করে বলল, “এই বিজ্ঞাপনের সমস্যা কী?”
“পরিষ্কার গুরুচণ্ডালী। চলিত এবং সাধুর মিশ্রণ। কবিগুরু এই বিজ্ঞাপনটা দেখলে আত্মহত্যা করতেন। যে এই ভাষায় বিজ্ঞাপন লিখে তাকে একুশে ফেব্রুয়ারি ভোরবেলা শহীদ মিনারে গুলি করে মারা উচিত।”
রতন মাথা চুলকে বলল, “আসলে, মানে হয়েছে কী এই বিজ্ঞাপনটা আমি পত্রিকায় পাঠিয়েছিলাম। ভাষার ব্যাপারটা মানে”
মানিক চোখ বড়ো বড়ো করে রতনের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি? তুমি এই বিজ্ঞাপন দিয়েছ? তু-তুমি?”
“হ্যাঁ। আমি।”
“কাকের বাচ্চা দিয়ে তুমি কী করবে?”
“আমার পরের প্রজেক্টটা হচ্ছে পাখি নিয়ে।”
“পাখি নিয়ে গবেষণা করতে চাও করো, আমার যত আপত্তি থাকুক আমি মেনে নেব। তাই বলে কাক? কাক নিয়ে গবেষণা?”
“কাক হচ্ছে—“
মানিক রতনকে কথা শেষ করতে দিল না, বলল, “কাক নিয়ে কোনো কবিকে কবিতা লিখতে দেখেছ? কোনো শিল্পীকে গান গাইতে শুনেছ? ভাস্করকে ভাস্কর্য বানাতে দেখেছ?”
“আমি তো কাকের উপর গান গাইব না। আমি কাককে নিয়ে—“
মানিক আবার রতনকে থামিয়ে দিল, “এটা টিয়া পাখি হতে পারত। কাকাতুয়া হতে পারত, কবুতর হতে পারত এমনকি শালিক হতে পারত, কিন্তু তাই বলে কাক?”
“আসলে হয়েছে কী–”
“আমি হচ্ছি কবি মানুষ। কবিরা সুন্দরের পূজারি। তুমি আমাকে বল কাকের মাঝে কোনো সৌন্দর্য আছে? তার গলার স্বর কর্কশ। প্রিয় খাবার মরা ইঁদুর। প্রিয় খেলা ছোটো শিশুর হাত থেকে ছোঁ মেরে খাবার নিয়ে যাওয়া–”
কয়েকবার কাকের বিষয়টা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে কোনো সুবিধে করতে না পেরে রতন আবার তার রবোটিক হ্যাঁন্ডের উপর ঝুঁকে পড়ল।
মানিক তার পাশে বসে টানা কথা বলে যেতে লাগল। বক্তব্য কাক থেকে চিল, চিল থেকে শকুন এবং শকুন থেকে শেষে মনুষ্যরূপী শকুন প্রজাতির দিকে যেতে লাগল। মানিক যখন রতনের কানের কাছে নিশ্বাস না ফেলে টানা কথা বলতে থাকে রতন তখন খুব সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করতে পারে, তার সমস্যার নানারকম সমাধান বের করে ফেলে। এবারেও সে দুই দুইটা জটিল সমস্যা কীভাবে সমাধান করবে বের করে ফেলল। মানিকের সাথে পরিচয় হবার। পর নিঃসন্দেহে তার গবেষণার কাজ অনেক ভালো হতে শুরু করেছে।
.
দুদিন পর লোকজন কাকের বাচ্চা নিয়ে আসতে শুরু করল। বিজ্ঞাপনে গুরুচণ্ডালী থাকলেও মানুষজন বিজ্ঞাপনের ভাষা পড়ে মানিকের মতো এত উত্তেজিত হলো না। প্রথম যে এলো তার সুচালো মুখ এবং তার সুচালো গোঁফ। চোখেমুখে একটা ধুরন্ধরের ভাব। রতনকে দেখে জিজ্ঞেস করল, “পত্রিকায় আপনি বিজ্ঞাপন দিছিলেন?”
ভাগ্যিস আশেপাশে মানিক ছিল না, সে শুদ্ধ ভাষা ছাড়া কথা বলে না, তার সামনে দিয়েছিলেন না বলে দিছিলেন বললে তার কপালে দুঃখ থাকে। রতন অবশ্যি ভাষা নিয়ে মাথা ঘামাল না, বলল, “হ্যাঁ। আমি দিয়েছিলাম।”
“বিজ্ঞাপন পরিষ্কার হয় নাইক্কা। আপনি বলেন নাই কয়টা কাউয়ার। বাচ্চা লাগবি। খুচরা না পাইকারি।”
রতন কখনো চিন্তা করে নাই এরকম একটা ব্যাপার হতে পারে। ভুরু কুঁচকে বলল, “আপনি কয়টা দিতে পারবেন?”
“সেইটা নির্ভর করে দামের ওপরে। পার পিছ কাউচার বাচ্চা কত করে দিবেন?”
“সেটা নিয়ে আমরা পরে আলোচনা করতে পারি। আগে আপনি দেখান। কয়টা এনেছেন?”
“সেম্পল হিসেবে একটা আনছি।”
“দেখান।”
মানুষটা তার হাতের ছোটো বাক্সটা থেকে খুব সাবধানে একটা মুরগির বাচ্চা বের করল। ছোটো এবং হলদে রঙের শরীরে কোমল পালক। বাক্স থেকে বের হয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে কিউ কিউ করে ডাকল।
রতন মুখ শক্ত করে বলল, “এটা কাকের বাচ্চা না। এটা মুরগির বাচ্চা।”
মানুষটা মুখ আরো বেশি শক্ত করে বলল, “এইটা কাউয়ার বাচ্চা।
রতন বলল, “আমি আপনার সাথে তর্ক করতে চাই না। এটা কাকের বাচ্চা না। আপনি একটা মুরগির বাচ্চা নিয়ে এসেছেন।”
“কাউচার বাচ্চা ছোট্ট থাকতি মুরগির বাচ্চার মতন থাকে। বড়ো হলি কাউয়ার বাচ্চার মতন হয়। হলুদ লোম পড়ে কালা লোম ওঠে।”
“আমি সেটা নিয়েও কথা বলতে চাই না। আপনি মুরগির বাচ্চাটাকে নিয়ে যান। আমি এটাকে কাকের বাচ্চা হিসেবে কিনব না। মুরগির বাচ্চাটাকে কষ্ট দিবেন না। যেখান থেকে এনেছেন সেখানে ফেরত দিয়ে দেবেন।”
মানুষটা তখন খুবই বিরস মুখে মুরগির বাচ্চাটা তার বাক্সে ঢোকাল। তারপর বলল, “কামটা ঠিক হইল না।”
রতন জিজ্ঞেস করল, “কোন কাজটা ঠিক হলো না?”
“আমারে পয়সা খরচ কইরা পুরান ঢাকা থেকি আনলেন। এখন বলেন আমার কাউয়ার বাচ্চা নিবেন না। এইটা নাকি মুরগির বাচ্চা! আপনার কারণে আমার বিশাল লস।”
রতন কিছু জিজ্ঞেস না করে ধুরন্ধর চেহারার মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল। মানুষটা বলল, “অন্তত আমারে ট্যাকি ভাড়টা দেন।”
“আপনাকে ট্যাক্সি ভাড়া দিতে হবে?”
“একশ বার। আমারে আপনে চিনেন না। পুরান ঢাকায় আমারে সবাই চিনে। আমি যেইটা বলি সেইটাই ফাইনাল। মুরগির বাচ্চা কইলে মুরগির বাচ্চা। কাউয়ার বাচ্চা বললে কাউয়ার বাচ্চা। পুলিশের সার্জেন্ট পর্যন্ত আমারে দেখলে সেলাম দেয়।”
মানুষটা তখন বুকের কাছে শার্টের একটা বোতাম খুলে শার্টের কলারটা সোজা করল। রতন বলল, “ঠিক আছে।”
তারপর গলা উঁচিয়ে ডাকল, “টাইগার!” সাথে সাথে বাঘের মতো গর্জন করে ভিতর থেকে এলসেশিয়ান কুকুরটা ডেকে উঠল, তারপর ভারি গলায় গর্জন করতে করতে ছুটে আসতে থাকে।