ময়না এলার্ম ক্লকটাকে নিয়ে সারা ঘরে লুটোপুটি খেল, কখনো কখনো। ঘরের কোণায় প্রায় চেপে ধরল, শেষ মুহূর্তে মনে হয় ইচ্ছে করেই ছেড়ে দিল! ময়নার মা যখন কাজ শেষ করে চলে যাবার জন্যে প্রস্তুত হয়েছে তখন মানিক স্পষ্ট বুঝতে পারল এলার্ম ক্লকটা রীতিমতো নেতিয়ে পড়েছে। ময়না সেটাকে খুব সহজেই ধরে ফেলল তারপর যে দড়ি দিয়ে। তাকে বাঁধা হতো সেই দড়ি দিয়ে এলার্ম ক্লকটাকে বেঁধে ফেলল। মানুষ। যেভাবে পোষা কুকুরকে দড়ি বেঁধে নিয়ে যায় ময়না সেভাবে এলার্ম ক্লকটাকে বেঁধে নিয়ে গেল। মানিক মুখে কৌতুকের হাসি নিয়ে দেখল এলার্ম ক্লকটা গোবেচারার মতো ছোটো ছোটো লাফ দিয়ে ময়নার পিছু পিছু যাচ্ছে!
.
পরদিন ভোরবেলা টেলিফোনের শব্দে মানিকের ঘুম ভাঙল। সে ঘুমঘুম গলায় ফোন ধরল, “কে?”
“আমি রতন।”
“ও! রতন।” আমি এখন ঘুমাচ্ছি, তুমি ঘণ্টাদুয়েক পর ফোন করতে পারবে? জরুরি কথা আছে।”
অন্যপাশ থেকে রতন চিৎকার করে বলল, “ঘুমাচ্ছ! এখনো ঘুমাচ্ছ। এলার্ম ক্লক তোমাকে তুলে দেয়নি?”
মানিক ঘুমঘুম গলায় বলল, “হ্যাঁ। তোমার এলার্ম ক্লক নিয়েই কথা। পরে ফোন কর।”
মানিক ফোন রেখে দেয়, রতন স্পষ্ট শুনতে পেল মানিক হালকাভাবে নাক ডাকতে শুরু করেছে।
.
ঘণ্টাদুয়েক পর রতন যখন আবার ফোন করেছে মানিক তখনও ঘুমাচ্ছে। আরো ঘন্টাদুয়েক পর যখন ফোন করছে তখন মানিকের ঘুম ভেঙেছে কিন্তু সে এখনো বিছানা থেকে নামেনি। রতন জিজ্ঞেস করল, “এলার্ম ক্লক তোমাকে ঘুম থেকে তুলতে পারেনি? এখনো ঘুমাচ্ছ?”
“এখন উঠে যাব। কাল ভালো ঘুম হয়নি তো তাই আজ একটু পুষিয়ে নিলাম। ভালোই হয়েছে তুমি ফোন করেছ, আমি তোমার সাথে কথা। বলতে চাচ্ছিলাম। হ্যাঁ তোমার এলার্ম ক্লকটা নিয়ে, এটা বাচ্চাদের জন্যে অসাধারণ একটা খেলনা হতে পারে।”
রতন খাবি খেল, “খেলনা?”
“হ্যাঁ। ছোটো বাচ্চারা এটার পিছনে দৌড়াদৌড়ি করে এটাকে ধরতে অসম্ভব পছন্দ করে। দড়ি দিয়ে বেঁধে নিলে এটা পোষা কুকুরের মতো পিছন-পিছনে যায়।”
“পোষা কুকুর?”
“হ্যাঁ। তুমি যদি চাও তাহলে আমি খেলনা কোম্পানির সাথে কথা বলতে পারি। আমার পরিচিত একজন ইন্ডাস্ট্রিতে আছে। সে অবশ্যি জাহাজ বানায়। যে জাহাজ বানাতে পারে সে কি খেলনা বানাতে পারবে না?”
“জাহাজ?”
“খেলনাটার একটা মজার নাম দিতে হবে। আমার কী মনে হয় জানো, এর মজার একটা নাম হতে পারে ডুগুডুও।”
“ডুগুডুগু?”
“হ্যাঁ। ডুডুগু।”
.
সারাদেশের বাচ্চাদের খুব শখের খেলনা ডুগুডুগুর এই হচ্ছে জন্ম ইতিহাস।
৩. কালাচান ধলাচান
রতন একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে টেবিলের উপর রাখা ছোটো একটা যন্ত্রকে খুব মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করছিল। মানিক প্রায় একইরকম মনোযোগ দিয়ে রতনকে পরীক্ষা করতে করতে ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “একসময় আমার ধারণা ছিল তুমি একজন বড়ো বিজ্ঞানী।”
রতন ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে টেবিলের উপর রাখা ছোটো যন্ত্রটা দেখতে দেখতে বলল, “এখন তোমার কী ধারণা হয়েছে?”
“এখন ধারণা নয়, এখন আমি নিশ্চিতভাবে জানি তুমি আসলে বিজ্ঞানী না।”
“আমি তাহলে কী?”
“তুমি হচ্ছ টয়-মেকার। খেলনা প্রস্তুতকারক। তুমি দিনের পর দিন বসে বসে খেলনা বানাও। এই যেরকম তুমি দিনের পর দিন বসে বসে দুটি হাত বানাচ্ছ। পুতুলের হাত।”
রতন কোনো কথা না বলে পুতুলের হাতের মতো যন্ত্রটা মানিককে দেখিয়ে বলল, “এটা?”
“হ্যাঁ, দুই হাত বানাতে দুই মাস। তারপর পা বাকি আছে। তারপর মাথা ঘাড় বুক পিঠ ঊরু।”
রতন বলল, “তোমার দুঃশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই হাত দুটি বানানোর পর আমার কাজ শেষ। মাথা পিঠ বুক এসব বানাতে হবে না।”
মানিক বিরক্ত হয়ে বলল, “কী আবোল-তাবোল বলছ? ঠিক করে বল।”
রতন অবাক হয়ে বলল, “ঠিক করে বলব? কী ঠিক করে বলব?”
“বলো, মাথা ঘাড় বুক পিঠ উরুছন্দ দিয়ে বলো।”
“রতন হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, আমার বলারই দরকার নাই। তুমি বলো। আমি শুনি।”
মানিক বলল, “কিন্তু তার আগে তুমি বলো হাত দুটো বানানোর পর তোমার কাজ শেষ কেন? একটা পুতুলের শুধু হাত থাকে না। সবকিছু থাকে।”
“আর যদি পুতুল না হয় তাহলে কি সবকিছু থাকতে হবে?”
“পুতুল না হলে মানে?”
“মানে এটা পুতুলের হাত না। এই দুটি হাত আসলে রবোটিক হ্যাঁন্ড। ইলেকট্রনিক সিগনাল দিয়ে এটা কন্ট্রোল করা যাবে। এই দুটো হাত সূক্ষ্মভাবে কাজ করতে পারবে। আর এটা কন্ট্রোল করার জন্যে যে ইন্টারফেসটা তৈরি করতে হয়েছে সেটা বানাতে আমার জান বের হয়ে গেছে। মাইক্রোস্কপিক আইসি কিনতে হয়েছে। যে এলগরিদম তৈরি। করতে হয়েছে—“
মানিক রতনকে বাধা দিয়ে বলল, “তুমি তোমার ভ্যাদর-ভ্যাদর থামাবে?”
রতন থতমত খেয়ে গিয়ে বলল, “আমি ভেবেছিলাম তুমি জানতে চাইছ–“
“আমি মোটেও তোমার আলু-করলা-দম শুনতে চাচ্ছি না।”
“শব্দটা আলু-করলাম না, শব্দটা এলগরিদম। তোমার শুদ্ধ করে বলা উচিত। অন্তত চেষ্টা করা উচিত।”
মানিক মুখ শক্ত করে বলল, “শুধু আমি শুদ্ধ বলার চেষ্টা করব, আর সারা পৃথিবীর মানুষ যা খুশি বলবে, যা খুশি লিখবে তাতে দোষ নেই?”
রতন জিজ্ঞেস করে, “কে কী বলেছে? কী লিখেছে?”
মানিক তার হাতে ধরে রাখা পত্রিকাটা খুলে বলল, “এই দেখো পত্রিকার একটা বিজ্ঞাপন–” তারপর জোরে জোরে পড়ে শোনাল, “কাকের বাচ্চা চাই। বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। উপযুক্ত মূল্য দেওয়া হইবে।”