ঠিক এরকম সময় খুট করে বাইরের দরজা খুলে ময়নার মা ঘরে ঢুকল। ময়নার মা মানিকের ঘরদোর পরিষ্কার করে রান্নাবান্না করে দেয়, সে যখন আসে তখন ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলে দিতে মানিকের আলসেমি লাগে তাই সে তার দরজার একটা চাবি ময়নার মাকে দিয়ে রেখেছে। ময়নার মা এভাবে বাসার চাবি নিতে আপত্তি করছিল, মানিক শোনেনি। জোর করে দিয়ে দিয়েছে। ময়নার মা দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে সোফায় মানিককে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে গেল, বলল, “বাই! আপনি আজকে এত সকালে জাগুইন্যা?”
মানিক বলল, “বাই বলে কোনো শব্দ নেই। শব্দ হচ্ছে ভাই। আর জাগুইন্যা বলে তুমি যদি জেগে ওঠা বুঝিয়ে থাক তাহলে হ্যাঁ আমি জাগুইন্যা।”
“কেন বাই? কোনো সমিস্যা?”
“সমিস্যা বলেও কোনো শব্দ নেই। শব্দটা সমস্যা। হ্যাঁ অনেক বড়ো সমস্যা। কিন্তু তুমি সেটা নিয়ে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করো না।”
“জে আচ্ছা।”
মানিক লক্ষ করল ময়নার মায়ের পিছন থেকে একটা ছোটো মাথা উঁকি দিল, এলোমেলো চুল বড়ো বড়ো চোখ। চোখে খানিকটা কৌতূহল এবং অনেকখানি ভয়। ময়নার মা বলল, “আমার মেয়ে ময়না।”
“আশ্চর্য! তোমার সত্যি সত্যি ময়না নামে মেয়ে আছে? আমি ভেবেছিলাম তোমার নামই হচ্ছে ময়নার মা।” মানিক তখন ছোটো মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল, “ময়না। আমার বাসায় তোমাকে স্বাগতম। আমি খুবই দুঃখিত আমার বাসায় তোমাকে আনন্দ দেবার মতো কিছু নেই।”
মানিকের কথা শুনে ময়না ভয় পেয়ে আবার তার মায়ের পিছনে লুকিয়ে গেল। ময়নার মা তখন ময়নাকে ধরে ঘরের ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বলল, “ময়না নামটা রাখা ঠিক হয় নাই। নাম রাখা উচিত ছিল কাউয়া।”
“শব্দটা কাউয়া না। শব্দটা কাক। তোমার এরকম ফুটফুটে মেয়ের নাম কাক রাখবে কেন? এরকম কথা মুখে আনাই রীতিমতো অপরাধ।”
ময়নার মা কোমরে গুঁজে রাখা একটা দড়ি বের করে ময়নার পায়ে বাঁধতে বাঁধতে বলল, “জন্মের দুষ্ট। জেবনটা তাবা করে দিল।”
মানিক ময়নার পায়ে দড়ি বাঁধতে দেখে অবাক হয়ে গেল, “জেবন” আর “তাবা” নামে দুটি বিচিত্র শব্দ পর্যন্ত হজম করে বলল, “তুমি ওর। পায়ে দড়ি দিয়ে বাঁধছ কেন?”
“সব সময় বেন্ধে রাখি। আপনি ঘুমায়ে থাকেন সেই জন্যে আপনি জানেন না। দড়ি দিয়ে টেবিলের সাথে বেন্ধে রাখি সে টেবিলের নীচে বসে বসে খেলে। আমারে ডিস্টার্ব দেয় না।”
“ডিস্টার্ব একটা ইংরেজি শব্দ। বাংলা বাক্যে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করা ঠিক না। কিন্তু সেটা নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে। আমি তোমাকে পরিষ্কার করে বলতে চাই, ময়নার মা, তুমি কিছুতেই একজন শিশুকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতে পারবে না। কিছুতেই না।”
ময়নার মা একটু হকচকিয়ে গেল, বলল, “বাই। যেদিন ময়নারে নিয়া আসতি হয় আমি দড়ি দিয়ে বেন্ধে রাখি। তা না হলে বাসার মদ্যি ঘুরি বেড়াবি। জিনিসপত্রে হাত দিবি।”
মানিক বলল, “আমার বাসায় বই ছাড়া কোনো জিনিসপত্র নেই। একটা ফুটফুটে মেয়ে যদি আমার বইয়ে হাত দেয় আমি খুবই খুশি হব। সেই বই যদি সে খুলে পড়ে আরো বেশি খুশি হব।” মানিক মেঘস্বরে বলে, “তুমি ময়নার পায়ের দড়ি খুলে দাও। সে বাসার মাঝে ছুটোছুটি করুক।”
“কিন্তু—“
“কোনো কিন্তু নেই।”
কাজেই ময়নার মাকে ময়নার পায়ের দড়ি খুলে দিতে হলো। ময়নার মুখে খুব সূক্ষ্ম একটা আনন্দের হাসি উঁকি দিয়ে গেল।
মানিক বলল, “ময়না, তুমি এই বাসায় যত ইচ্ছা ঘুরে বেড়াতে পার। যেটা ইচ্ছে ধরতে পার, শুধু “ মানিক মেঝেতে নিরীহভাবে বসে থাকা এলার্ম ক্লকটা দেখিয়ে বলল, “এই ঘড়িটা থেকে সাবধান।”
ময়নার মা বলল, “ঘড়ি ফোলোরের উপর রাখছেন কেন?”
“তুমি নিশ্চয়ই ফ্লোর বলার চেষ্টা করছ। মেঝে বলে একটা চমৎকার বাংলা শব্দ থাকার পরও তুমি কেন ভুল উচ্চারণে ফ্লোর বলার চেষ্টা করছ আমি জানি না। যাই হোক ময়নার মা, আমি এই ঘড়িটা মেঝেতে রাখিনি। কেমন করে এটা মেঝেতে এসেছে আমি সেটা নিয়ে আলোচনা করতে চাই না। তুমি যদি এটাকে ধরে এই বাসা থেকে দূর করতে পার তোমাকে আমি বিশেষ বোনাস দেব।”
“ঘড়িটা ফালায়া দিমু?”
“হ্যাঁ।”
ময়নার মা এগিয়ে এসে এলার্ম ক্লকটা ধরার চেষ্টা করল আর সাথে সাথে সেটা ছোটো একটা শব্দ করে লাফ দিয়ে সরে গেল। ময়নার মা ভয় পেয়ে একটা বিকট চিৎকার দিয়ে পিছনে সরে এল এবং তখন প্রথমবারের। মতো ময়নার মুখে সত্যিকারের আনন্দের হাসি ফুটে ওঠে। মানিক লক্ষ করল ময়নার সামনের কয়েকটা দাঁত নেই এবং দাঁতহীন এই হাসিটার মতো সুন্দর কিছু সে বহুদিন দেখছে কি না মনে করতে পারল না।
ময়নার মা দরজা ধরে বড়ো বড়ো নিশ্বাস নিয়ে নিজের বুকে থুতু দিয়ে চোখ বিস্ফারিত করে এলার্ম ক্লকটার দিকে তাকিয়ে রইল এবং ময়না আনন্দে চিৎকার করে এলার্ম ক্লকটা ধরার জন্যে সেটার উপর লাফিয়ে পড়ল। এলার্ম ক্লকটা ছোটো একটা শব্দ করে লাফ দিয়ে সরে যায়, ময়না সেটাকে একটুর জন্যে ধরতে পারে না। তারপর যেটা ঘটল সেটার জন্যে মানিক একেবারে প্রস্তুত ছিল না, মানিক অবাক হয়ে দেখল ময়না তার ফোকলা দাঁত বের করে খিলখিল করে হাসতে হাসতে একেবারে মাটিতে গড়িয়ে পড়ে। এই ব্যাপারটাতে যে সত্যি সত্যি আনন্দের একটা বিষয়। আছে এই প্রথম মানিক সেটা লক্ষ করল। ময়না একটু পরেই আবার উঠে দাঁড়ায় তারপর আবার সেটা ধরার চেষ্টা করল, এলার্ম ক্লকটা আবার লাফ দিয়ে সরে গেল আর ময়না আবার খিলখিল করে হাসতে লাগল! ময়নার হাসি দেখে মানিকও প্রথমে মৃদুভাবে এবং একটু পরে উচ্চস্বরে হাসতে থাকে একটা মজার জিনিসকে সে বোকার মতো ভয়ের জিনিস ভেবে আছে সেটা এই বাচ্চা মেয়েটা তাকে প্রথমবার বুঝিয়ে দিল।