মানিক এবারে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল, সাথে সথে এলার্ম ক্লকটা হঠাৎ থেমে গেল। বিকট একটা কর্কশ আওয়াজ থেমে যাবার পর পুরো ঘরটা মানিকের কাছে কেমন যেন বেশি নীরব মনে হতে থাকে। বুকের ভেতর থেকে একটা স্বস্তির নিশ্বাস বের করে দিয়ে মানিক আবার তার বিছানায় বসে পড়ে আর সাথে সাথে এলার্ম ক্লকটা আগের চেয়ে জোরে চিৎকার করতে শুরু করে। মানিক ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো লাফ দিয়ে আবার উঠে দাঁড়ায় আর সাথে সাথে বিকট আওয়াজটা থেমে যায়। মানিক বুঝতে পারল এই এলার্ম ক্লকটা তাকে বিছানা থেকে নামিয়ে ছাড়বে। বিছানায় বসলেই এটা চিষ্কার করবে।
এতক্ষণে মানিকের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে, সে জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। তার এত সাধের সকালের ঘুমের পুরোপুরি বারোটা বেজে গেছে। মানিক আরেকবার সাহস করে এলার্ম ক্লকটা ধরার চেষ্টা করল, সাথে সাথে এলার্ম ক্লকটা লাফ দিয়ে সরে গিয়ে আবার বিকট একটা শব্দ করে মানিককে জানিয়ে দিল যে তাকে ঘাটাঘাটি করলে সে আবার শব্দ করতে শুরু করবে।
মানিক কী করবে বুঝতে না পেরে এক পা পিছনে গেল, এলার্ম ক্লকটা কোনো কিছু করল না। সে ডান দিকে দুই পা এগিয়ে গেল তখন এলার্ম ক্লকটাও নিজে থেকে ডান দিকে ঘুরে গেল। মানিক বাম দিকে একটু সরে এল। আর কী আশ্চর্য! এলার্ম ক্লকটাও বাম দিকে ঘুরে গেল। মানিকের পরিষ্কার একটা অনুভূতি হলো যে এলার্ম ক্লকটা তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। মানিক সাবধানে পা টিপে টিপে ঘর থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করল সাথে সাথে এলার্ম ক্লকটা বিকট স্বরে চিৎকার শুরু করে। মানিক তখন তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে এল, এলার্ম ক্লকটাও সাথে সাথে থেমে গেল। মানিক বুঝতে পারল এই এলার্ম ক্লকটা তাকে বিছানায় শুতে দিতে চায় না–সে যেন অন্য কোনো ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়তে না পারে সেজন্যে চোখের আড়ালও করতে চায় না।
মানিক কবি মানুষ। সে সহজে রেগে ওঠে না, রেগে উঠলেও সে কখনোই মাথা গরম করে না, একটু আধটু মাথা গরম করলেও সে কখনো। গলা উঁচু করে কথা বলে না। কিন্তু আজকে সব নিয়ম ভেঙে সে হাত পা নেড়ে চিৎকার করে এলার্ম ক্লকটাকে বলল, “বেটা বদমাইস! বেজন্মা। কোথাকার, তোর এত বড়ো সাহস–”
আর যায় কোথায়! এলার্ম ক্লকটা তার জায়গায় একটা ছোটো লাফ দিয়ে বিকট স্বরে চিৎকার করতে থাকে, সেই চিৎকার এত ভয়ংকর যে। মানিকের প্রায় হার্টফেল করার অবস্থা। সে প্রায় না বুঝেই দুই হাত জোড় করে মাপ চাওয়ার ভঙ্গি করে নরম গলায় বলতে থাকে, “প্লিজ! প্লিজ। প্লিজ! রাগ করো না–আর কখনো বলব না মাপ করে দাও।”
এলার্ম ক্লকের শব্দটা তখন আস্তে আস্তে কমতে থাকে। তারপর। একসময় থেমে যায়। মানিকের তখন বুঝতে বাকি থাকে না, এলার্ম ক্লকটা শুধু যে তাকে চোখেচোখে রাখতে চায় তা না, সেটার সাথে গলা উঁচু করে কথাও বলা যাবে না! মানিক এক ধরনের হিংস্র দৃষ্টিতে এলার্ম ক্লকটার দিকে তাকিয়ে থাকে তার এখনো বিশ্বাস হয় না একটা এলার্ম ক্লক তাকে এরকম বিপদে ফেলতে পারে। সে তখন সাবধানে এগিয়ে টেবিলের একপাশে রাখা তার মোবাইল টেলিফোনটা হাতে নিয়ে রতনকে ফোন করল। অন্য পাশে রতন নেই কিন্তু মানিক রতনের গলা শুনতে পেল, “মানিক, এটা আমি না, এটা আমার রেকর্ডিং—“
মানিক দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, “আমি তোমার রেকর্ডিংয়ের বংশ নিপাত করি–”
“তুমি আমাকে কিছু বলছ কি না আমি জানি না–” রেকর্ডিং বলে চলল, “খামোখা চেষ্টা করো না, আমি শুনতে পাব না। যেহেতু তুমি ফোন। করছ আমি ধরে নিচ্ছি আমার এলার্ম ক্লকটা ঠিক ঠিক সময়ে তোমাকে ঘুম থেকে তুলতে পেরেছে। হা হা হা–যাই হোক এলার্ম ক্লকটা ধরতে পারলে এটাকে তুমি বন্ধ করে দিতে পারবে কিন্তু তোমাকে বলা হয়নি এটাকে ধরা খুব সোজা না। আমি আমার রিয়েল টইম ডাইনামিক এলগরিদম এটার মাঝে ঢুকিয়ে দিয়েছি। তোমার বাসায় এই এলগরিদমের ফিল্ড টেস্ট হচ্ছে। ফিরে এসে আমি তোমার কাছ থেকে রিপোর্ট নেব।”
মানিক দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলল, “তোমার ফিল্ড টেস্টের চৌদ্দগুষ্টির নিপাত করি।”
রতনের গলার রেকর্ডিং বলতে লাগল, “আরো একটা কথা মানিক, তোমাকে বলা হয়নি। যন্ত্রপাতিকে তুমি অপমান করতে পছন্দ কর, কাজেই এটাকে তুমি যতো ইচ্ছা অপমান করতে পার, শুধু খেয়াল রাখবে গলার স্বর যেন উঁচু না হয়। তার কারণ এটার মাঝে সংবেদনশীল কণ্ঠস্বর পরিমাপের সফটওয়ারটাও আছে। হা হা হা।”
রতনের কথা পুরোপুরি শেষ হবার আগেই মানিক তার মোবাইল টেলিফোনটা মেঝেতে ছুঁড়ে মারল, শক্ত মোবাইল সেট, এটা দিয়ে সে দেওয়ালে পেরেক ঠুকে ঢুকিয়ে দেয় সেটার কিছু হলো বলে মনে হলো না। শুধু এলার্ম ক্লকটা নিজের জায়গায় একটা লাফ দিয়ে ঘুরে মানিকের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল।
ঘণ্টাখানেক পর মনে হলো এলার্ম ক্লকটা একটু শান্ত হয়েছে, মানিক তখন খুব সাবধানে শোবার ঘর থেকে বের হয়ে বাইরের ঘরে এসে তার সোফায় বসে পড়ল। অবাক ব্যাপার হলো এলার্ম ক্লকটা ছোটো ছোটো লাফ দিয়ে তার পিছু পিছু শোবার ঘরে চলে এল। দেখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে সেটা তাকে চোখে চোখে রাখছে। মানিক সোফায় বসে দুই হাতে তার মাথা চেপে ধরে পুরো ব্যাপারটা ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করার চেষ্টা করল, লাভ হলো না, প্রত্যেকবারই তার মাথা আগের থেকে গরম হয়ে উঠতে লাগল। একটা তুচ্ছ এলার্ম ক্লক তাকে এভাবে অপদস্ত করবে সেটা মানিক কোনদিন কি চিন্তা করেছিল? সে খানিকক্ষণ সোফায় বসে লম্বা লম্বা কয়েকটা নিশ্বাস ফেলল–তার প্রিয় একটা কবিতার লাইন আবৃত্তি করে। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল, তাতেও খুব একটা লাভ হলো না, বরং তার মাথায় অন্য একটা কবিতার লাইন ঝিলিক করে উঠে, “এক ডান্ডায় ঠান্ডা করে দাও পৃথিবীর যত এলার্ম ক্লক…”