“ছেড়ে দাও।”
মানিকের গলাটা ধরে এল। ভাঙা গলায় বলল, “তারপর আত্মীয় স্বজনের আত্মীয় স্বজন–”
রতন বুঝতে পারল বিষয়টা একটু বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। তাই সে মানিককে ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “চল, আমাদের এখন সাপের বাজারে যাওয়ার কথা।”
মানিক বলল, “চল। বিষাক্ত সাপ দেখে আমাকে বিষাক্ত স্মৃতির কথা ভুলতে হবে।”
.
এক সপ্তাহ পর রতন মানিককে একটা ছোটো বাক্স দিয়ে বলল, “এটা তোমার জন্যে উপহার।”
বাক্সটা খুব সুন্দর, রঙিন কাগজে মোড়ানো। দেখে মানিকের চোখমুখ আনন্দে ঝলমল করে উঠল, বলল, “আমার জন্যে উপহার?”
“হ্যাঁ।”
“আমার উপহার পেতে খুব ভালো লাগে।”
“সবারই ভালো লাগে, কিন্তু আমি জানি না, এই উপহারটা তোমার ভালো লাগবে কি না।”
“কেন?”
রতন বলল, “তার কারণ এটা একটা যন্ত্র। তুমি তো বলেছ তুমি যন্ত্র পছন্দ করো না।”
মানিকের মুখটা একটু বিমর্ষ হয়ে গেল, বলল, “যন্ত্র? কী যন্ত্র?”
“খুবই সোজা যন্ত্র। একটা এলার্ম ক্লক। তুমি বলেছিলে তোমার সকালে উঠতে সমস্যা হয় সেই জন্যে তৈরি করে দিলাম।”
“এলার্ম ক্লক? এলার্ম ক্লক তোমার তৈরি করতে হলো? আমি মাসে চার-পাঁচটা এলার্ম ক্লক কিনি! কিনি আর ভাঙি।”
“সেইজন্যেই তো তৈরি করে দিলাম। এটা ভাঙবে না। আর এই এলার্ম ক্লকটার মনে করো গণ্ডারের চামড়া, তুমি যতই অপমান করো, গালাগাল করো সে সবকিছু সহ্য করবে। তোমার যেভাবে খুশি তুমি এটাকে অপমান করতে পারবে।”
মানিকের মুখের বিমর্ষ ভাবটা এবারে একটু কমল, বলল, “অপমান করতে পারব?”
“পারবে।”
“দূরে ছুঁড়ে মারতে পারব?”
“অবশ্যই।”
“চমৎকার।” বলে মানিক রঙিন কাগজের মোড়কটাকে খুলে ভেতর থেকে একটা এলার্ম ক্লক বের করল, একেবারেই সাধারণ এলার্ম ক্লক, সে প্রায় নিয়মিত এরকম এলার্ম ক্লক বাজার থেকে কিনে আনে। তবে বাজার। থেকে যেটা কিনে আনে সেগুলোর থেকে এটা একটু ভারি।
মানিক বলল, “তুমি এত বড়ো বৈজ্ঞানিক, কত কিছু আবিষ্কার করে ফেলতে পার, ড্রাইভার ছাড়া গাড়ি চালাতে পার। আর তুমি কি না তৈরি করলে একটা এলার্ম ক্লক!”
রতন হাসল, বলল, “তোমার জন্যে আলাদা করে তৈরি করেছি!”
“যখন বাজতে শুরু করবে তখন টিপি দিলেই বন্ধ হয়ে যাবে তো?”
“হ্যাঁ। টিপি দিলেই বন্ধ হয়ে যাবে। আমি সকাল সাতটার জন্যে সেট করে দিয়েছি। তুমি ইচ্ছে করলে এটা অন্য সময়ের জন্যে সেট করতে পার।”
মানিক বলল, “সাতটাই ভালো। এলার্ম ক্লক ঘুমটাকে একটু হালকা করে দেয়। আবার নতুন করে ঘুমাই–তখন খুবই ভালো লাগে। দশটা এগারোটার দিকে যখন উঠি তখন শরীরটা একেবারে ঝরঝরে লাগে।”
রতন বলল, “ভেরি গুড।”
.
সেদিন রাত্রে ঘুমানোর সময় রতন মানিককে ফোন করল, বলল, “মানিক, ঘুমিয়ে পড়েছ নাকি?”
“শুয়েছি। এখনো ঘুমাইনি।”
“কাত হয়ে শুয়ে কাত হয়ে থাকা টেলিভিশন দেখছ?”
“ঠিকই অনুমান করেছ।”
“আমি তোমাকে ফোন করলাম, মনে করিয়ে দেবার জন্যে। এলার্ম ক্লকটা সেট করেছ তো?”
মানিক বলল, “তোমার চিন্তা করার কোনো কারণ নেই। আমি এলার্মটা সেট করে আমার মাথার কাছে রেখেছি।”
“গুড। আর শোনো আমি আজ রাতে একটু শ্রীমঙ্গলের দিকে যাচ্ছি। সপ্তাহখানেকের জন্যে। এক সপ্তাহ পরে দেখা হবে।”
“ঠিক আছে। আমি ফোন করে তোমার খোঁজ নেব।”
রতন বলল, “আমি যেখানে যাচ্ছি সেখানে দুই দিকে টিলা, টেলিফোনের নেটওয়ার্ক নাই। ফোন করে মনে হয় আমাকে পাবে না।”
“কোনো সমস্যা নেই।”
মানিক ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করেনি যে আসলে অনেক বড়ো সমস্যা তার জন্যে অপেক্ষা করছে।
.
ঠিক ভোর সাতটার সময় রতনের দেওয়া এলার্ম ক্লকটা বেজে উঠল। প্রথমে এলার্ম ক্লকের শব্দটা হলো মিষ্টি একটা বাজনার মতো, মানিক সেই শব্দটা প্রায় উপভোগ করতে শুরু করছিল ঠিক তখন সেটা কর্কশ শব্দ করতে শুরু করল। মানিক ঘুম ঘুম চোখে হাত বাড়িয়ে এলার্ম ক্লকটা ধরার চেষ্টা করতেই একটা খুব বিচিত্র ব্যাপার ঘটল। এলার্ম ক্লকটা ছোটো একটা লাফ দিয়ে সরে গেল। শুধু যে সরে গেল তা না, সরে গিয়ে আরো কর্কশ শব্দে বাজতে লাগল। সারাজীবন মানিকের জীবনে যেটা ঘটেনি আজকে সেটা ঘটে গেল, তার এত সাধের ঘুমটা একটা চোট খেয়ে গেল। সে চোখ মেলে দেখার চেষ্টা করল সত্যিই এলার্ম ক্লকটা লাফ দিয়ে সরে। গেছে নাকি তার চোখের ভুল।
মানিক দেখল এলার্ম ক্লকটা সত্যিই একটু দূরে বসে বিকট স্বরে চিৎকার করছে। সে হাত বাড়িয়ে আবার সেটা ধরার চেষ্টা করল আর কী আশ্চর্য সেটা সত্যি সত্যি ব্যাঙের মতো একটা লাফ দিয়ে মাথার কাছে রাখা টেবিলটার অন্য পাশে সরে গেল। শুধু তাই না, মনে হলো এলার্ম। ক্লকটা আরো জোরে শব্দ করতে শুরু করেছে।
মানিকের ঘুমটা এখন পুরোপুরি ভেঙে গেল। সে তার বিছানায় উঠে বসে এক ধরনের বিস্ময় আর আতঙ্ক নিয়ে এলার্ম ক্লকটার দিকে তাকিয়ে থাকে। নিজেকে সামলে নিয়ে সে আবার এলার্ম ক্লকটা ধরার চেষ্টা করল আর কী আশ্চর্য এবারে সেটা লাফ দিয়ে মেঝেতে নেমে এল। নিজের চোখে দেখেও মানিকের বিশ্বাস হতে চায় না। তার ভেতরে কেমন যেন একটা জেদ চেপে যায়, সে আবার সেটাকে ধরার চেষ্টা করল আর এলার্ম ক্লকটা আবার লাফ দিয়ে সরে গেল। এবারে সে দুই হাতে সেটাকে জাপটে ধরার চেষ্টা করল, প্রায় ধরেই ফেলেছিল আর একেবারে শেষ মুহূর্তে সেটা পিছলে গিয়ে হাত ফসকে বের হয়ে গেল। এলার্ম ক্লকটার শব্দটা এবারে। কেমন যেন একটা হাসির মতো শোনাতে থাকে।