যেমন আমি বলি, “এই যে ইলেকট্রিক লাইট, তুমি কি দেখছ এখন চারিদিকে কী চমৎকার সূর্যের আলো? এই চমৎকার সূর্যের আলোতে তোমার কি নিজেকে অত্যন্ত অকিঞ্চিকর মনে হচ্ছে না? তোমার আলো কতো ক্ষুদ্র কতো তুচ্ছ কতো নগণ্য দেখেছ? এইরকম কথা।”
রতন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “তোমার বাসায় কম্পিউটার আছে?”
মানিক মাথা নাড়ল, বলল, “না নাই। আমি কম্পিউটারকে ঘৃণা করি।”
রতন চোখ কপালে তুলে বলল, “ঘৃণা? তুমি বলছ ঘৃণা?”
“হ্যাঁ। যন্ত্রদের মাঝে সবচেয়ে বড়ো ক্রিমিনাল হচ্ছে কম্পিউটার।”
“ক্রিমিনাল?”
“হা। এটা যন্ত্র হয়েও এমন ভান করে যে এটা যন্ত্র না। এটা কীসের যন্ত্র সেটা নিয়েও সবাইকে ফাঁকি দেয়। কেউ বলে গান শোনার যন্ত্র, কেউ বলে সিনেমা দেখার কেউ বলে হিসাব করার, কেউ বলে চিঠি লেখার। এরকম কেন হবে? আগে ঠিক করে নিক এটা কীসের যন্ত্র তারপর আমি এটা স্পর্শ করব। তাছাড়া_”
“তাছাড়া কী?”
“তাছাড়া আমি নেতিবাচক নামের জিনিস পছন্দ করি না।”
“নেতিবাচক?”
“হ্যাঁ। নাম হচ্ছে কম্পিউটার। কম কেন? কোন জিনিসটা কম? যখন তৈরি হবে বেশি-পিউটার তখন দেখা যাবে।”
রতন বলল, “মানিক, তুমি মনে হয় একটা জিনিস বুঝতে পারছ না। এর নামটা এসেছে
মানিক রতনকে কথা শেষ করতে দিল না, বলল, “তোমাকে যদি বলা হয় কমবুদ্ধির একটা মেয়েকে বিয়ে করতে হবে, তুমি কি রাজি হবে? হবে না। তুমি চাইবে বেশি বুদ্ধির একটা মেয়ে। ঠিক সেইরকম কেন আমি কমপিউটারে রাজি হব? আমার দরকার বেশি-পিউটার।”
রতন হাল ছেড়ে দিল, মানিক ছাড়ল না, সে কথা বলে যেতেই লাগল। শেষপর্যন্ত যখন ক্লান্ত হয়ে একটু থামল তখন রতন জিজ্ঞেস করল, “এই যে তুমি যন্ত্রপাতিকে ঘৃণা কর, তাদের অপমান কর এর জন্যে তোমার কখনো কোনো সমস্যা হয় নাই?”
“হলে হয়েছে, কিন্তু সে জন্যে আমি আমার নীতিকে বিসর্জন দেইনি।”
“কী সমস্যা হয়েছে?”
“এই তো” বলে মানিক হাত নেড়ে বিষয়টা শেষ করে দেবার চেষ্টা করল।
রতন অবশ্যি সেটা মেনে নিল না, বলল, “তুমি শুধু তোমার দিকটা বলে যাকে মন্ত্রকে তুমি কীভাবে অপমান করেছ তা হবে না। যন্ত্রকে অপমান করার জন্যে যন্ত্র তোমাকে কী শাস্তি দিয়েছে সেটাও বলতে হবে।”
“সেটা এমন কিছু না।”
“তবুও শুনি।”
মানিক ইতস্তত করে বলল, “যেমন ধর থার্মোমিটারের ব্যাপারটা। মানুষের শরীরে হাত দিলেই বোঝা যায় জ্বর আছে কি নেই–খামোখা থার্মোমিটার নামে একটা যন্ত্র তৈরি হয়েছে। তাই থার্মোমিটারকে অপমান করার জন্যে আমি সেটাকে মানিক কথা থামিয়ে থেমে গেল।
“কী হলো, থামলে কেন বল। কী করতে থার্মোমিটার দিয়ে?” মানিক ইতস্তত করে বলল, “কান চুলকাতাম।”
রতন চমকে উঠে বলল, “সর্বনাশ! কানের ভিতর থার্মোমিটার ভেঙে গেলে কেলেংকারি হয়ে যাবে। থার্মোমিটারে থাকে পারদ, ভেঙে কানের ভিতর ঢুকে গেলে”
মানিক ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “হ্যাঁ। ডাক্তার খুব রাগ করেছিল”
“তার মানে সত্যি সত্যি তোমার কানের ভিতর থার্মোমিটার ভেঙে গিয়েছিল? কী সর্বনাশ!”
মানিক আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আগের দিনে ডাক্তাররা খুবই হৃদয়বান মানুষ ছিল। আজকালকার ডাক্তারেরা হৃদয়হীন এবং আবেগ বিবর্জিত।”
রতন মাথা নেড়ে বলল, “ডাক্তার কি তোমাকে কিল ঘুষি দিয়েছিল?”
“না। কিন্তু যে ভাষায় আমার সাথে কথা বলেছে সেটা কোনো সভ্য মানুষের উপযোগী ভাষা না। অমার্জিত বর্বর মানুষের ভাষা–”
“তোমার কপাল ভালো আমি ডাক্তার না, আর কানের ভিতর থার্মোমিটার ভেঙে তুমি আমার কাছে আস নাই। আমি হলে নির্ঘাত তোমাকে দুই এক ঘা লাগাতাম।”
মানিক খুব অল্প সময়ের মাঝে তার তিন নম্বর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তোমরা বিজ্ঞানের মানুষেরা হৃদয়হীন। কাঠখোট্টা বিজ্ঞান তোমাদের সমস্ত আবেগ সমস্ত কোমল অনুভূতি শুষে নিয়েছে। আমি একজন কবি মানুষ, সুন্দরের পূজারী, আমার সাথে এই ভাষায় কথা বলা যায় না। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার পর”
“তোমাকে হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল?”
“হ্যাঁ। কিন্তু আমি সেটা নিয়ে কথা বলতে চাই না। যখন একজন মানুষ কানে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে শুয়ে থাকে তখন যদি দূরদূরান্ত থেকে মেডিকেল স্টুডেন্টরা তাকে দেখতে আসে এবং তখন যদি তাকে কানের ভেতর থার্মোমিটার ভাঙা পাগল হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়, সেটা খুবই হৃদয়বিদারক। আমি সেই সব মুহূর্তের কথা মনে করতে চাই না। কমবয়সি সুন্দরী মেডিকেল স্টুডেন্টদের খিলখিল হাসির কথা আমি স্মরণ করতে চাই না।”
রতন খুব ভালো করে জানে কেউ কোনো কিছু স্মরণ করতে না চাইলেই যে সেটা তার স্মরণ হবে না এটা সত্যি নয় তাই মানিকের সবকিছু স্মরণ হতে লাগল। তার মুখচোখে একটা গভীর দুঃখের ছায়া পড়ল। রতনের মানিকের জন্যে একটু মায়া হলো, তাই বলল, “খামোখা ওই সব কথা মনে করে লাভ নেই–”
মানিক বলল, “তুমি চিন্তা করতে পারবে না। কী নিষ্পাপ চেহারার মেয়ে কিন্তু কী ভয়ংকর নিষ্ঠুর!”
রতন বলল, “ছেড়ে দাও।”
“একজন আরেকজনকে ধরে কী খিলখিল হাসি।”
“ছেড়ে দাও।”
“শুধু মেডিকেল স্টুডেন্ট না, আস্তে আস্তে নার্স ওয়ার্ডবয় সবাই আসতে লাগল।”
“ছেড়ে দাও।”
“তারপর রোগীরা আসতে শুরু করল।”
“ছেড়ে দাও।”
“তারপর রোগীদের আত্মীয় স্বজন”