মানিক মুখ গম্ভীর করে বলল, “শুধু ঘড়ি না আমি মোবাইল ফোনকেও আমার জীবন নিয়ন্ত্রণ করতে দেব না। কক্ষনো না।”
“খুব ভালো কথা। তাহলে তুমি কেন আমাকে তোমার মোবাইল টেলিফোন নম্বর দিয়ে বললে, সকালে ফোন করো। ঘুম থেকে তুলে দিও। আমি ফোন করেছি–”
“ও!” মানিকের চোখ মুখ হঠাৎ ঝলমল করে উঠে, “এখন বুঝতে পেরেছি! কী সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখছিলাম সাদা রাজহাঁস পানিতে ভাসছে। ঠিক তখন টেলিফোন দিল ঘুমটা ভাঙিয়ে তার মানে সেটা ছিল তোমার টেলিফোন! তুমি ফোন করে আমার ঘুম ভাঙিয়েছ?”
“আমি মোটেই তোমার ঘুম ভাঙাতে পারি নাই। তাহলে তুমি এগারোটার সময় আসতে না।”
“ঘুমটা ভেঙেছিল কিন্তু আমি টেলিফোনটা বন্ধ করে আবার ঘুমিয়ে গেলাম। স্বপ্নে রাজহাঁসগুলো আর পেলাম না, এবারে শুধু পাতিহাঁস।”
রতন হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, “তোমার টেলিফোন বন্ধ করার কথা না। তোমার উঠে বসার কথা, ঘুম থেকে জেগে ওঠার কথা। সত্যি কথা বলতে কী, এলার্ম দিয়ে তোমার নিজেরই ঘুম থেকে ওঠার কথা।”
মানিক মুখ শক্ত করে বলল, “আমি এলার্ম ক্লককে আমার জীবন নিয়ন্ত্রণ করতে দেব না। কক্ষনো না।”
“তুমি কখনো এলার্ম ক্লক দিয়ে ঘুম থেকে ওঠার চেষ্টা করেছ?”
“অবশ্যই করেছি। আমি প্রত্যেক রাতে ঘুমানোর সময় আমার এলার্ম ক্লকটা সেট করি। সকাল সাতটার জন্যে।”
“তারপর?”
“সকাল সাতটায় এলার্ম বাজে আমি তখন ঘুমের মাঝে এলার্মটা বন্ধ করে আবার ঘুমিয়ে যাই। পৃথিবীর কোনো এলার্ম ক্লক আমাকে কখনো ঘুম থেকে তুলতে পারেনি।”
রতন সরু চোখে মানিকের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কি এমন কোনো এলার্ম ক্লক চাও যেটা তোমাকে ঘুম থেকে তুলে দিতে পারবে?”
“না চাই না।”
রতন মাথা নেড়ে বলল, “আমি সেটাই ভেবেছিলাম।”
“কী ভেবেছিলে?”
“তুমি এলার্ম ক্লকটা ব্যবহার করো যেন সেটা তোমার ঘুমটা একটু ভাঙানোর চেষ্টা করে আর তখন সেটাকে বন্ধ করে তুমি আরো জোরেসোরে পাগলের মতো ঘুমাও।”
মানিকের মুখটা আনন্দে ঝলমল করে উঠল, মাথা নেড়ে বলল, “তুমি একেবারে ঠিক ধরেছ! আমি যখন একটা যন্ত্রকে অপমান করি তখন আমার এক ধরনের আনন্দ হয়!”
“অপমান?”
“হ্যাঁ।”
“যন্ত্রকে অপমান করা যায় সেটা আমি এই প্রথম তোমার কাছে শুনলাম।”
মানিক গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়ল, বলল, “করা যায়। তুমি যদি চাও আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব।”
রতন বলল, “আমি শিখতে চাই না।”
“না চাইলেও শিখিয়ে দিতে পারি।” মানিক উদারভাবে হেসে বলল, “যন্ত্রকে অপমান করতে হয় তাকে গুরুত্ব না দিয়ে। যে যন্ত্রের যে কাজ সেটা না করিয়ে সেটা দিয়ে অন্য অসম্মানজনক কাজ করিয়ে।”
“অসম্মানজনক কাজ?”
“হ্যাঁ। যেমন মোবাইল টেলিফোন আমি ব্যবহার করি দেওয়ালে পেরেক ঠোকার জন্যে।”
রতন চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল, কিছু-একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল, শেষ পর্যন্ত বলল না। মানিক পকেট থেকে তার টেলিফোনটা বের করে দেখিয়ে বলল, “এই দেখ একটু ফেটেফুটে গেছে। অপমানের চূড়ান্ত।”
“আর কী কর?”
“যেমন মনে করো টেলিভিশন। সেটা আমার বিছানার পিছনে কাত করে রেখেছি।”
“কাত করে রেখেছ?”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
“আমি যখন কাত হয়ে শুয়ে থাকি তখন যেন দেখতে পারি।”
“যখন সোজা হয়ে বসে থাক কিংবা দাঁড়িয়ে থাক?”
“তখন টেলিভিশনের উপর আমি আমার জুতো মোজা রাখি। চূড়ান্ত অপমান।”
রতন মাথা নাড়ল, বলল, “টেলিভিশনের বোঝার ক্ষমতা থাকলে তার কাছে এটা চূড়ান্ত অপমান মনে হতে পারত। তুমি ঠিকই বলেছ।”
মানিক উৎসাহ পেয়ে বলল, “তারপর মনে করো ফ্রিজ। ফ্রিজকে আমি ব্যবহার করি ঘর ঠান্ডা করার জন্যে। যখন গরম পড়ে তখন আমি ফ্রিজের দরজা খোলা রাখি।”
রতন মাথা নেড়ে বলল, “এভাবে কখনো ঘর ঠান্ডা হয় না।”
“না হলে নাই, কিন্তু ফ্রিজের অপমান তো হয়। ফ্রিজের মাঝে আমি ময়লা কাপড় রাখি সেইটাও অপমান।”
রতন মাথা নাড়ল। মানিক বলল, “তারপর মনে করো ইলেকট্রিক ইস্ত্রি। আমি সেটা দিয়ে রুটি টোস্ট করি।”
“রুটি টোস্ট কর?”
“হ্যাঁ। একটা পাউরুটির স্লাইস প্লেটে রেখে তারপর উপর গরম ইস্ত্রি চেপে ধরি। রুটিটা তখন টোস্ট হয়। ইস্ত্রিটাকে তখন আমি অপমানসুচক কথা বলি।”
“তুমি ইস্ত্রির সাথে কথা বল?”
“হ্যাঁ। অপমানসুচক কথা।”
“কী রকম কথা?”
মানিক মুখ সুচালো করে বলল, “যেমন আমি বলি, ধিক ইস্ত্রি ধিক। ধিক তোমার এই অর্থহীন জীবন। তুমি ধ্বংস হও, তোমার কানেকশান ছুটে তুমি জঞ্জালে পরিণত হও আমি তোমাকে সেই অভিশাপ দিই”
রতন বলল, “কানেকশান ছুটে তোমার ইস্ত্রি জঞ্জালে পরিণত হলে তোমার আরেকটা ইস্ত্রি কিনে আনতে হবে, তোমার টাকা পয়সা নষ্ট হবে, তারপরেও তুমি এই অভিশাপ দাও?”
“হ্যাঁ। দিই।” মানিক হঠাৎ করে গম্ভীর হয়ে বলল, “আমি কোনো যন্ত্রকে আমার জীবন নিয়ন্ত্রণ করতে দেব না।”
“তুমি আর কোন কোন যন্ত্রকে অপমান কর?”
“সব যন্ত্রকে। যখন আলোর দরকার হয় তখন আমি একটা একটা লাইট নিভিয়ে ঘর অন্ধকার করে মোমবাতি জ্বালাই। মোমবাতির আলোতে কাজ করি আর ইলেকট্রিক লাইটগুলোকে হালকা গালাগাল করি।”
“তাতে লাইটগুলোর অপমান হয়?”
“না। পুরোপুরি অপমান হয় না। তাই যখন দিনের বেলা অনেক আলো থাকে তখন সব লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে তাদেরকে অপমানসূচক কথা বলি।”
“কী রকম অপমানসূচক কথা বল?”