মূল প্রসেসর শুষ্ক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, তুমি কী করতে চাও রিরা?
প্রথমত মহাকাশযানে যে অসংখ্য মৃতদেহ পড়ে আছে, সেগুলো যথাযযাগ্য মর্যাদা দিয়ে সমাহিত করতে চাই। সেটা সম্ভব না হলে সেগুলোকে অন্তত হিমঘরে সংরক্ষণ করতে চাই।
কাজটা একটু কঠিন হবে। মহাকাশযানের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ অনেক জায়গায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কঠিন হলেও করতে হবে। রিরা একটু থেমে যোগ করল, আমি এতগুলো মৃতদেহের মাঝে একদিনও থাকতে পারব না।
রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্র থেকে যদি দুএকটি নিচু শ্রেণীর রোবট অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়, তা হলে তাদেরকে ব্যবহার করা যেতে পারে।
ঠিক আছে। মৃতদেহগুলো সরিয়ে নেবার পর মহাকাশযানটিকে পরিষ্কার করতে হবে। সব জায়গা রক্ত এবং ক্লেদে মাখামাখি হয়ে আছে।
ভ্যাকুয়াম সিস্টেম ব্যবহার করে সেটা সহজেই পরিষ্কার করা যাবে।
আমার থাকার জন্য খানিকটা জায়গা পরিষ্কার করে দিলেই আপাতত কাজ চলে। যাবে।
সেটি কোনো সমস্যা নয়, ক্যাপ্টেনের নিজস্ব অতিরিক্ত কেবিনটি তুমি ব্যবহার করতে পারবে। সেখানে আরামদায়ক বিছানা, ব্যক্তিগত আনন্দের জন্য বিনোদন কেন্দ্র, বিশেষ স্নায়ু-উত্তেজক পানীয় এই সবকিছু আছে।
তার কোনো প্রয়োজন নেই। এখন মৃতদেহ সংরক্ষণের কাজ শুরু করে দেওয়া যাক।
রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্র থেকে চারটি নিচু শ্রেণীর রোবট পেয়ে যাবার পরও মহাকাশকেন্দ্রের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মৃতদেহগুলো শীতল ঘরে নিয়ে সংরক্ষণ করে মহাকাশযানটি ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে মোটামুটি ব্যবহারযোগ্য করতে করতে প্রায় আট ঘণ্টা সময় ব্যয় হয়ে গেল। কাজ শেষ করে রিরা যখন ক্যাপ্টেনের অতিরিক্ত কেবিনে শুতে এসেছে, তখন সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। বিছানায় শোয়ার সাথে সাথে তার চোখে ঘুম নেমে এল–শুনতে পেল তার মহাকাশযানের মূল প্রসেসর শুষ্ক কণ্ঠে বলছে, রিরা, অভুক্ত অবস্থায় ঘুমিয়ে যাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তুমি আর কিছু না হলেও বলকারক একটু পানীয় মুখে দিয়ে নাও।
না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে শরীরের কী কী ক্ষতি হতে পারে আবছাভাবে শুনতে শুনতে রিরা গভীর ঘুমে ঢলে পড়ল।
রিরার ঘুম ভাঙল ভয়ংকর খিদে নিয়ে। ঘুম থেকে উঠে সে খানিকক্ষণ নরম বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে রইল। তার মনে পড়ল—সে একটি মহাকাশযানে একা এবং এই মহাকাশযানটি আগামী কয়েকদিনের মাঝেই পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে। ব্যাপারটি নিয়ে তার যেরকম বিচলিত হওয়ার কথা ছিল, সে সেরকম বিচলিত হল না। কোনো একটা অজ্ঞাত। কারণে তার ভাবনা-চিন্তা সবকিছুই কেমন যেন ভোতা হয়ে এসেছে। রিরা কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে রইল; মহাকাশযানের ইঞ্জিনের চাপা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে–গুঞ্জনটির মাঝে কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে, যদিও সে পরিবর্তনটা ঠিক ধরতে পারল না। রিরা একসময় উঠে দাঁড়াল, শরীরের অবসাদ কেটে গেছে, ভালো করে কিছু খেয়ে নিতে পারলে সে দিনটি ভালোভাবে শুরু করতে পারবে। মহাকাশযানের সব মহাকাশচারী মারা গিয়েছে, বেঁচে আছে শুধু সে একা–জেনে প্রথমে তার ভেতরে এক ভয়াবহ আতঙ্কের জন্ম হয়েছিল। সে কী করবে কিছুতেই ঠিক করতে পারছিল না। মহাকাশযানটি কয়েকদিনের মাঝে ধ্বংস হয়ে যাবে শুনে হঠাৎ করে তার আতঙ্ক এবং অস্থিরতা পুরোপুরি কেটে গেছে, সে আবিষ্কার করেছে তার আসলেই কিছু করার নেই। কাজেই জীবনের শেষ কয়টি দিনকে এখন যতটুকু সম্ভব অর্থবহ করাই হতে পারে একমাত্র অর্থপূর্ণ কাজ।
রিরা দীর্ঘ সময় নিয়ে শরীর পরিষ্কার করে সত্যিকার পানিতে স্নান সেরে নিয়ে পরিষ্কার একটি ওভারঅল পরে নেয়। ক্যাপ্টেনের সুদৃশ্য টেবিলে বসে সে যখন কী খাবে সেটা নিয়ে। মহাকাশযানের প্রসেসরের সাথে কথা বলছিল, ঠিক তখন তার নীলমানবটির কথা মনে পড়ল। কী আশ্চর্য! সে একটি আহত নীলমানবকে রক্তক্ষরণ হয়ে মারা যাবার জন্য একটা ঘরে বন্ধ করে রেখে তার কথা পুরোপুরি ভুলে গেছে। রিরা তার বিছানায় বসে দ্রুত খেয়ে নেয়। এক টুকরো রুটি, সত্যিকারের মাখন, পনির এবং খানিকটা কৃত্রিম প্রোটিন। খাবার শেষে এক মগ গরম কফি। রিরা খাওয়া শেষ করে তার অস্ত্রটি খুঁজে বের করে কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে কার্গো বের করিডরের শেষ মাথায় বন্ধ ঘরটিতে হাজির হল। সাবধানে তালা খুলে সে দরজা টেনে ভেতরে উঁকি দেয়, মনে মনে আশা করেছিল নীলমানবটি এতক্ষণে মরে গিয়ে সব ঝামেলা চুকিয়ে দিয়েছে, কিন্তু সে দেখতে পেল নীলমানবটি এখনো বেঁচে আছে। রিরা নিজের ভেতরে এক ধরনের ক্রোধ অনুভব করে, সে তার অস্ত্রটি হাতবদল করে হিংস্র আক্রোশ নিয়ে নীলমানবটির দিকে তাকাল, দাঁতে দাঁত ঘষে চাপা গলায় বলল, এখনো বেঁচে আছ?
নীলমানবটি কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর আশ্চর্য রকমের এক ধরনের ভরাট গলায় বলল, পানি।
পানি! রিরা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না, আহত নীলমানবটি তার কাছে পানি চাইতে পারে সেটি নিজের কানে না শুনলে সে বিশ্বাসই করত না। রিরা ক্রুদ্ধ গলায় বলল, আমার মহাকাশযানের সব মানুষকে একজন একজন করে গুলি করে মেরে ফেলেছ, এখন তুমি আমার কাছে পানি চাইছ, তোমার সাহস তো কম না! পানি নয়, তোমার মাথার খুলিতে চতুর্থ মাত্রার বিস্ফোরক দিয়ে একটা বুলেট পাঠানো দরকার। বুঝেছ?
নীলমানবটি ধৈর্য ধরে রিয়ার কথা শেষ হবার জন্য অপেক্ষা করল, তারপর আবার ঠিক আগের মতো ভরাট গলায় বলল, পানি।