রিরা নীলমানবটির মাথার দিকে অস্ত্রটি উদ্যত করে রেখে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে এবং হঠাৎ করে বুঝতে পারল নীলমানবটি নিরস্ত্র ও আহত। পায়ের কাছাকাছি কোথাও গুলি লেগেছে। নীল রক্ত চুইয়ে চুইয়ে পড়ে পুরো জায়গাটা কালচে হয়ে আছে। নীলমানবটি ইচ্ছে করলেই তাকে হত্যা করতে পারবে না বুঝতে পেরে হঠাৎ সে তার শরীরে শক্তি ফিরে পায়, অস্ত্র হাতে দুই পা পিছিয়ে গিয়ে সে অস্ত্রটি নীলমানবের মাথার দিকে তাক করে। হত্যা খুব ভয়ংকর ব্যাপার, তারপরেও আমাদের হত্যা করতে হয়। ক্যাপ্টেন বর্কেন বলেছিলেন, নিজেকে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনে অন্যকে হত্যা করতে হয়। রিরা এই মুহূর্তে নীলমানবটিকে হত্যা করবে। সে অস্ত্রটি নীলমানবের মাথার দিকে তাক করে ট্রিগার টেনে ধরল। কান ফাটানো বিস্ফোরণের শব্দে পুরো ঘর প্রকম্পিত হওয়ার কথা ছিল কিন্তু কোনো শব্দ হল না; খট করে একটা শব্দ করে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি মৃদু ঝাকুনি দিয়ে কেঁপে উঠল মাত্র। রিরা অস্ত্রটির দিকে তাকায় গুলি শেষ হয়ে গেছে। কোমর থেকে নতুন ম্যাগজিন বের করে অস্ত্রতে লোড করে আবার সেটি উদ্যত করল নীলমানবের মাথার দিকে। নীলমানবটি স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে কী ভয়ংকর ক্রুর তার দৃষ্টি, মুখমণ্ডলে কী ভয়ংকর নিষ্ঠুরতা! একটু আগে কী নৃশংসভাবেই না তারা এই মহাকাশের সবাইকে হত্যা করেছে। রিরা ট্রিগারে চাপ দিতে গিয়ে থেমে গেল, দৃষ্টিতে কি শুধু অমানবিক নিষ্ঠুরতা? তার সাথে কি একটু ভয়, একটু আতঙ্ক এবং শূন্যতা নেই তাকে হত্যা না করার জন্য কাতর প্রার্থনা নেই? বেঁচে থাকার জন্য আকুলতা নেই?
রিরা অস্ত্রটি নামিয়ে রাখল, পায়ে গুলি লেগে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, নীলমানবটি এমনিতেই মারা যাবে তার মাথায় গুলি করে তাকে আলাদাভাবে হত্যা করার প্রয়োজন নেই। সে ঘরটির চারদিকে তাকাল, এখান থেকে বের হয়ে যাবার কোনো উপায় নেই। বাইরে থেকে তালা দিয়ে রাখলে নীলমানবটি এই ঘর থেকে বের হতে পারবে না—আপাতত আটকে থাকুক এই ঘরে। রিরা ঘরটি বন্ধ করে বের হয়ে এল।
কন্ট্রোলরুমের দরজায় ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে থাকা নীলমানবটির মৃতদেহ ডিঙিয়ে রিরা কন্ট্রোলরুমের ভেতরে এসে ঢোকে। ক্যাপ্টেন বর্কেন যে চেয়ারটিতে বসতেন, তার পাশে দাঁড়িয়ে সে সুইচ স্পর্শ করল। মহাকাশযানের ক্যাপ্টেন ছাড়া আর কেউ এই কন্ট্রোল প্যানেল ব্যবহার করার কথা নয়। কিন্তু এখন পুরোপুরি ভিন্ন একটা অবস্থা, জরুরি অবস্থায় যে-কেউ মূল প্রসেসরের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। শিক্ষানবিশ মহাকাশচারী হিসেবে তাদেরকে অনেকবার এ ধরনের পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। রিরা তার রেটিনা স্ক্যান করিয়ে গোপন পাসওয়ার্ডটি প্রবেশ করাল। সাথে সাথেই উত্তর আসার কথা কিন্তু কোনো উত্তর না এসে মনিটরটি নিরুত্তর হয়ে রইল। রিরা এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করে, সে দ্বিতীয়বার চেষ্টা করল। দুই চোখের রেটিনা স্ক্যান করিয়ে সে আবার গোপন পাসওয়ার্ডটি প্রবেশ করাল। কয়েক মুহূর্ত পরে মনিটরে কিছু আলোর বিচ্ছুরণ দেখা যায় এবং শুষ্ক কণ্ঠস্বরে মূল প্রসেসর যোগাযোগ করার চেষ্টা করল, জরুরি পর্যায় আট, আমি আবার বলছি মহাকাশযানে জরুরি পর্যায় আট।
রিরা এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করে। মহাকাশযান অভ্যন্তরীণ বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবার পূর্বমুহূর্তে জরুরি পর্যায় দশ ঘোষণা করা হয় এই মহাকাশযানটি সেই পর্যায় থেকে মাত্র দুই পর্যায় উপরে রয়েছে। নীলমানবেরা যখন মহাকাশযানে আক্রমণ করেছিল, তখন মহাকাশযানটিকে নিশ্চয়ই পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছে। জরুরি পর্যায় পাঁচ পর্যন্ত মহাকাশযান সহ্য করতে পারে। জরুরি পর্যায় আট পৌঁছে গেলে সেটা পরিত্যাগ করে সরে যাবার কথা—যে কোনো মুহূর্তে সেটা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। রিরা কাপা গলায় বলল, আমি মহাকাশ্যানচারী রিরা। মহাকাশযানে একমাত্র জীবিত মানুষ আমার সাহায্যের প্রয়োজন।
শুষ্ক কণ্ঠস্বরে মহাকাশযানের প্রসেসর উত্তর করল, এই মহাকাশযান খুব শিগগিরই ধ্বংস হয়ে যাবে। মহাকাশযানের বায়ুর পরিশীলন সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বাতাসের চাপ কমে আসছে। কুরু ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জ্বালানি টিউবে ফুটো হওয়ার কারণে জ্বালানি ছড়িয়ে পড়ছে।
রিরা নিশ্বাস বন্ধ করে বলল, কেন্দ্রীয় মহাকাশ কেন্দ্রে খবর পাঠানো প্রয়োজন। জরুরি সাহায্য না পেলে–
বিস্ফোরণের কারণে যোগাযোগ কেন্দ্র নষ্ট হয়ে গেছে। আমাদের পক্ষে বাইরে যোগাযোগ করা সম্ভব নয়।
রিরা আর্তচিৎকার করে বলল, বাইরে যোগাযোগ করা সম্ভব নয়?
না।
এই মহাকাশযানটা কয়েকদিনের মাঝে ধ্বংস হয়ে যাবে?
হ্যাঁ। মহাকাশযানে বাতাসের চাপ কমে আসছে। ইঞ্জিনঘরে যে জ্বালানি ছড়িয়ে পড়েছে, যে কোনো মুহর্তে সেটা দিয়ে বিস্ফোরণ হতে পারে।
এবং সাহায্য পাবার কোনো আশা নেই?
মহাকাশযানের মূল প্রসেসর শুষ্ক কণ্ঠে বলল, সাহায্য পাবার সম্ভাবনা দশমিক শূন্য তিন।
চমৎকার! রিরা হঠাৎ আবিষ্কার করল পুরো ব্যাপারটি নিয়ে তার যেরকম অস্থির হয়ে যাবার কথা ছিল, সে মোটেও সেরকম অস্থির হয়ে উঠছে না। বরং পুরো ব্যাপারটা সে বেশ সহজভাবেই মেনে নিয়েছে। একটা নিশ্বাস ফেলে সে বেশ শান্ত গলায় বলল, যদি তা-ই সত্যি হয় যে, এই মহাকাশযানে আগামী কয়েকদিনই আমার জীবনের শেষ কয়েকদিন, তা হলে সময়টা আমি ভালোভাবে কাটাতে চাই।