ক্যাপ্টেন বৰ্কেন শব্দ করে হাসলেন, বললেন, যদিও সেই সুযোগটা হচ্ছে খুব অল্পবয়সে নীলমানবের হাতে খুন হয়ে যাওয়ার সুযোগ।
কার্গো বে-র করিভরে বড় ধাতব দরজার নিচু অংশে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি বসিয়ে রিরা। অপেক্ষা করতে থাকে। দূরে গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। নীলমানবেরা গুলি করতে করতে ছুটে আসছে। নৃশংস নীলমান নিয়ে তার খুব কৌতূহল ছিল, একটু পরেই তাদেরকে সে দেখবে। প্রথমবার তাদেরকে সামনাসামনি দেখবে। হয়তো শেষবার।
০৩. রিরা খুব ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল
রিরা খুব ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। মহাকাশযানটিতে এক বিস্ময়কর নীরবতা। কিছুক্ষণ আগেই ভয়ংকর শব্দে পুরো মহাকাশযানটি কেঁপে কেঁপে উঠছিলএখন হঠাৎ করে এই নৈঃশব্দ্যকে অসহনীয় আতঙ্কের মতো মনে হতে থাকে। রিরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি হাতে নিয়ে চারদিকে তাকাল। পুরো মহাকাশযানটি একটি ধ্বংসস্তুপের মতো, দেয়ালে বড় বড় গর্ত, ধাতব বিম ভেঙে পড়েছে, এদিকে সেদিকে আগুন ধিকিধিকি করে জ্বলছে, চারদিকে কালো। ধোয়া এবং পোড়া গন্ধ।
রিরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে পুরো মহাকাশযানে কোথাও কোনো জীবিত প্রাণীর শব্দ নেই। কারো কথা, কাবো নিশ্বাস, এমনকি যন্ত্রণার একটু কাতরধ্বনিও নেই। নীলমানব আর এই মহাকাশযানের মহাকাশচারীরা কি তা হলে পরস্পর পরস্পরকে একেবারে পরিপূর্ণভাবে নিঃশেষ করে দিয়েছে? হঠাৎ করে রিয়ার ভেতরে এক অচিন্তনীয় আতঙ্ক এসে ভর করে—সে কি তা হলে এই মহাকাশযানে একমাত্র জীবিত প্রাণী? রিরা ফিসফিস করে নিজেকে বলল, না না—এটা হতে পারে না। কেউ না কেউ নিশ্চয়ই বেঁচে আছে। নিশ্চয়ই বেঁচে আছে।
রিরা খুব সতর্ক পায়ে হাঁটতে শুরু করে, তীক্ষ্ণ চোখে সে তাকায়—কোথাও কি কেউআছে?
করিডরের গোড়ায় সে ক্যাপ্টেন বর্কেনের মৃতদেহটি দেখতে পেল ভয়ংকর গোলাগুলির মাঝে থেকেও তার মৃতদেহটি আশ্চর্যরকম অক্ষত। মুখে এক ধরনের প্রশান্তির চিহ্ন, দেখে মনে হয় কোনো একটা কিছু দেখে কৌতুক বোধ করছেন।
রিরা কিছুক্ষণ মৃতদেহটির কাছে দাঁড়িয়ে রইল, তার ভেতরে দুঃখ, ক্রোধ বা হতাশা কোনো ধরনের অনুভূতিই নেই, সে ভেতরে এক ধরনের আশ্চর্য শূন্যতা অনুভব করে। রিরা অনেকটা যন্ত্রের মতো মৃতদেহটি ডিঙিয়ে এগিয়ে যেতে শুরু করে।
দুজন নীলমানবের মৃতদেহ পাওয়া গেল কন্ট্রোলরুমের দরজায়। শক্তিশালী কোনো বিস্ফোরকের আঘাতে একজনের মস্তিষ্কের বড় অংশ উড়ে গেছে। গুলির আঘাতে দ্বিতীয়জনের বুকের একটা অংশ ছিন্নভিন্ন হয়ে আছে। কালচে এক ধরনের রক্তে পুরো জায়গাটা ভিজে আছে। মহাকাশযানের অভিযাত্রীদের মৃতদেহের বেশিরভাগ তাদের কেবিনের কাছাকাছি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। তাদের বেশিরভাগই ছিল নিরস্ত্র, প্রতিবোধ দূরে থাকুক নিজেদের রক্ষা করার সুযোগও কেউ পায় নি। ইঞ্জিনঘরের কাছাকাছি মনে হয় একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছে, সেখানে ইতস্তত অনেকগুলো মৃতদেহ পড়ে আছে। নীলমানবদের মৃতদেহের বেশিরভাগই কুরু ইঞ্জিনের আশপাশে মনে হয় তারা ইঞ্জিনটা ধ্বংস করতে চেষ্টা করেছিল। উপরে নিরাপত্তাকর্মীরা থাকায় শেষপর্যন্ত ধ্বংস করতে পারে নি। ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের মৃতদেহটি পাওয়া গেল কন্ট্রোল প্যানেলের উপর তার পায়ের কাছেই একজন নীলমানবের মৃতদেহ পড়ে আছে। আশপাশে চারদিকে ধস্তাধস্তির চিহ্ন একপর্যায়ে মনে হয় অস্ত্র হাতে এরা হাতাহাতি যুদ্ধ করেছে, কিন্তু শেষরক্ষা হয় নি, একটি মানুষ কিংবা নীলমানবও বেঁচে নেই। পুরো ইঞ্জিনঘরটির ভেতরে মনে হয় একটা প্রলয়কাণ্ড ঘটে গেছে তার ভেতরে ধক ধক শব্দ করে এখনো ইঞ্জিনটি চলছে, সেটাই একটি রহস্য।
রিরা ইঞ্জিনঘর থেকে বের হয়ে কমিউনিকেশনস ঘরে গেল, সেখান থেকে মূল প্রসেসর ঘরে। প্রসেসর ঘর থেকে শীতলঘর, সেখান থেকে কার্গোঘরে—কোথাও একজন জীবিত প্রাণী নেই। একজন মানুষ কিংবা একজন নীলমানব কেউ বেঁচে নেই। এই পুরো মহাকাশযানে সে একা অসংখ্য মানুষ এবং নীলমানবের মৃতদেহ নিয়ে মহাকাশ পাড়ি দেবে-রিরা হঠাৎ করে অসহনীয় আতঙ্কে থরথর করে কাপতে শুরু করে।
ঠিক তখন সে একটা শব্দ শুনতে পেল, কোনো একজনের পদশব্দ কিংবা কোনো কিছু সরে যাবার শব্দ। নিজের অজান্তেই সে চিৎকার করে উঠল, কে?
নিঃশব্দে মহাকাশযানে তার চিঙ্কার প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে কিন্তু কেউ তার প্রশ্নের উত্তর দেয় না। রিরা তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি হাতে নিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে চারদিকে তাকায়। কোনো মহাকাশচারী হলে নিশ্চয়ই তার প্রশ্নের উত্তর দিত—এটি হয়তো কোনো নীলমান। ভয়ংকর দুর্ধর্ষ নৃশংস একজন নীলমানব। রিরা নিশ্বাস বন্ধ করে তার অস্ত্রটি ধরে রাখে, কোনো একটা কিছুকে নড়তে দেখলেই সে গুলি করবে।
আবার কিছু একটা নড়ে যাবার শব্দ হল—মনের ভুল নয়, নিশ্চিত শব্দ, কোনো জীবন্ত প্রাণীর সরে যাবার শব্দ। রিরা শক্ত হাতে তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে এগুতে থাকে, করিডরের পাশেই একটা ছোট ঘর, তার ভেতর থেকে শব্দটা এসেছে। দরজার সামনে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ করে লাথি দিয়ে দরজাটা খুলে অস্ত্র উদ্যত করে ভেতরে ঢুকে গেল সে—একমুহূর্ত সে নিশ্বাস নিতে পারে না আতঙ্কে। দেয়ালে হেলান দিয়ে স্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে একজন নীলমানব। কী ভয়ংকর ক্রুর সে দৃষ্টি! রিরার সমস্ত শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল আতঙ্কে।