রিরা ভয় পাওয়া মুখে বলল, কী হয়েছে মহামান্য ক্যাপ্টেন? কী হয়েছে?
ক্যাপ্টেন বৰ্কেন খুব ধীরে ধীরে তার চেয়ারে বসে ফিসফিস করে বললেন, আমরা সবাই শেষ হয়ে গেলাম।
কী বললেন? আর্তচিৎকার করে রিরা বলল, কী বললেন আপনি?
আমরা শেষ হয়ে গেলাম। কেউ আর আমাদের রক্ষা করতে পারবে না।
কেন?
নীলমানবেরা নিথিলিয়াম গ্যাস দিয়ে আক্রান্ত হয় নি। তারা ভান করেছে আক্রান্ত হয়েছে।
আপনি কেমন করে জানেন?
সবাই অচেতন হয়েছে একইভাবে একই ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে উপুড় হয়ে কারো মুখ দেখা যাচ্ছে না—সবাই মুখ ঢেকে রেখেছে।
এখন কী হবে?
ওরা উঠে দাঁড়াবে।
ক্যাপ্টেন বর্কেনের কথা শেষ হবার আগেই ঘরের একেবারে অন্যপ্রান্তে পড়ে থাকা নীলমানবটি উঠে দাঁড়াল–হঠাৎ করে লাফিয়ে নয়, খুব সহজ ভঙ্গিতে। যেন কিছুই হয় নি কোনো একজন পুরাতন বন্ধুকে দেখে একজন মানুষ যেভাবে উঠে দাঁড়ায় সেভাবে। তারপর টলতে টলতে সে এগিয়ে আসতে থাকে নিরাপত্তা বাহিনীর দলটির দিকে। নিরাপত্তা বাহিনীর দলটি হতচকিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে—কী করবে বুঝতে পারে না।
রিরা চাপা গলায় বলল, এখন কী হবে?
গুলি করবে। গুলি করে মারবে নীলমানবটিকে।
কেন মারবে?
কথা শেষ হবার আগেই প্রচণ্ড শব্দে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র গর্জন করে উঠল—নীলমানবটির শরীর ঝরা হয়ে যায় মুহর্তে ঝনঝন করে কাচ ভেঙে পড়ল ঘরের ভেতর!
ঘরের ভেতর বিশুদ্ধ বাতাস আনার ব্যবস্থা করল আর ভয় নেই নীলমানদের। নিথিলিয়ামে অচেতন থাকবে না কেউ।
ক্যাপ্টেন বৰ্কেনের কথা শেষ হবার আগেই ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকা নীলমানবেরা উঠে দাঁড়ায়, টলতে টলতে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল নিরাপত্তা বাহিনীর মানুষগুলোর ওপর। প্রচণ্ড গুলির শব্দে কানে তালা লেগে গেল, ধোয়ায় অন্ধকার হয়ে গেল চারদিক।
তুমি কিছু বোঝার আগে নলিমানবেরা ছুটে আসবে—একজন একজন করে সবাইকে হত্যা করবে ওরা। ক্যাপ্টেন বর্কেনের গলার স্বর হঠাৎ আশ্চর্যরকম শান্ত হয়ে গেল, তিনি মাথা নেড়ে বললেন, কী আশ্চর্য! আমি এই সহজ জিনিসটা বুঝতে পারি নি।
রিরা রক্তশূন্য মুখে মনিটরটির দিকে তাকিয়ে রইল। মনিটরে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, নীলমানবেরা অস্ত্র কেড়ে নিয়েছে প্রতিরক্ষা বাহিনীর দলটির থেকে বায়ু নিরোধক পোশাক পরে থাকায় তারা ঠিকভাবে নড়তে পারছিল না, ক্ষীপ্র নীলমানবেরা অবলীলায় তাদের কাবু করেছে। প্রচণ্ড গোলাগুলিতে বেশ কয়জন নীলমানবের শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে কিন্তু সেজন্য কারো ভেতর এতটুক ভয়ভীতি বা দুর্বলতা এসেছে বলে মনে হল না। নীলমানবেরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে বেপরোয়াভাবে গুলি করতে করতে ছুটে আসছে। তাদের ভাবলেশহীন মুখে এই প্রথমবার হিংস্র প্রতিহিংসার একটা চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দুর্বোধ্য ভাষায় চিৎকার করতে করতে তারা মহাকাশযানের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। পুরো মহাকাশযানটাকে একটা ধ্বংসস্তুপে পরিণত না করে তারা থামবে না।
রিরা ক্যাপ্টেন বর্কেনের দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা এখন কী করব মহামান্য ক্যাপ্টেন?
ক্যাপ্টেন বৰ্কেন অন্যমনস্কভাবে মাথা নেড়ে বললেন, আমাদের করার কিছু নেই। এই মহাকাশযানে যারা আছে, তারা সাধারণ মহাকাশচারী। এই নীলমানবেরা যোদ্ধা ওদের হাতে এখন অস্ত্র। আমাদের আর কিছু করার নেই।
কিন্তু–
ক্যাপ্টেন বৰ্কেন এক ধরনের স্নেহ নিয়ে রিরার দিকে তাকিয়ে শোনা যায় না এরকম গলায় বললেন, আমরা যদি নীলমানবদের ভেতরে এই ভয়ানক প্রতিহিংসার জন্ম না দিতাম, তা হলে হয়তো এই অবস্থা হত না। নীলমানদের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত ছিল।
কিন্তু এখন কিছুই কি করতে পারব না?
ক্যাপ্টেন বৰ্কেন উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, কিছু একটা চেষ্টা অবশ্যই করতে হবে। কার্গো বে থেকে মূল মহাকাশযানের করিডরটাতে যদি এদের কিছুক্ষণ আটকে রাখা যায়, তা হলে মহাকাশযানের অন্য ক্রুরা হয়তো খানিকটা সময় পাবে। তারা হয়তো কিছু ভারী অস্ত্র বের করে এনে সত্যিকারের একটা প্রতিরোধ দিতে পারে।
ক্যাপ্টেন বৰ্কেন দেয়ালের একটা সুইচ স্পর্শ করে বেশ বড় একটা অংশকে নামিয়ে আনলেন। ভেতরে বড় বড় কিছু স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র সাজানো। তিনি একটা বহুঁ ব্যবহৃত অস্ত্র টেনে নামিয়ে দক্ষ হাতে লোভ করে বললেন, কখনো ভাবি নি এটা আবার ব্যবহার করতে হবে। ভেবেছিলাম খুনোখুনির পর্যায় পার হয়ে এসেছি।
রিরা দেয়াল থেকে অন্য একটি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নামিয়ে নিল, ক্যাপ্টেন বৰ্কেন তাকে বাধা দিলেন না। এই অস্ত্র কে কখন কীভাবে ব্যবহার করতে পারবে—সেটি নিয়ে নানারকম নিয়মকানুন আছে, কিন্তু সেসব এখন পুরোপুরি অর্থহীন। ক্যাপ্টেন বৰ্কেন বললেন, তুমি ডান দিক দিয়ে যাও, আমি বাম দিকে আছি, মিনিট পাচেক আটকে রাখতে পারলেই অনেক। মাথা ঠাণ্ডা রেখ–খুব কাছে না আসা পর্যন্ত গুলি করো না। নিশানা ঠিক রেখ–হত্যা খুব ভয়ংকর একটা ব্যাপার—কিন্তু তারপরেও আমাদের করতে হয়। বেঁচে থাকার জন্য ফুড চেইন নামে একটা প্রক্রিয়ায় একজন প্রাণী অন্য প্রাণীকে বহুদিন থেকে হত্যা করে আসছে। মনে রেখ যত বেশিজন নীলমানবকে হত্যা করতে পারবে, আমাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা তত বেশি।
রিরা মাথা নাড়ল, ক্যাপ্টেন বৰ্কেন তার হাত স্পর্শ করে বললেন, আমি খুব দুঃখিত রিরা। খুব দুঃখিত।
আপনার সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়ে আমি অত্যন্ত সম্মানিত বোধ করছি।