নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান ক্রুশ একটি নিশ্বাস ফেলে সহজ গলায় বললেন, মহামান্য বর্কেন, আমার মনে হয় আপনার সন্দেহটি অমূলক। নীলমানবের আত্মহত্যাটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আমাদের মহাকাশযান দখল করার প্রক্রিয়া এটা নয়।
ক্যাপ্টেন বৰ্কেন কিছুক্ষণ ক্রুশের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, আমি সত্যিই চাই যে, তোমার ধারণা সত্যি প্রমাণিত হোক এবং আমি ভুল প্রমাণিত হই। কিন্তু–
কিন্তু?
ক্যাপ্টেন বৰ্কেন হাত দিয়ে বড় মনিটরের সুইচটা স্পর্শ করে সেটা অন করে দিলেন। নীলমানবদের ঘরের দৃশ্যটি মুহূর্তের মাঝে ফুটে উঠল।
একজন নীলমান মেঝেতে নিথর হয়ে শুয়ে আছে। তার চোখ দুটো খোলা, ভান হাতটি অবসন্ন হয়ে পাশে পড়ে আছে। কবজির খানিকটা অংশ কাটা। সেখান থেকে রক্ত চুইয়ে চুইয়ে বের হয়ে শরীরের নিচে জড়ো হয়েছে। রক্তের রঙ নীল, এখন কালচে হয়ে জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। তার মাথার কাছে একজন নীলমানব স্থির হয়ে বসে আছে–তার মুখ পাথরের মতো ভাবলেশহীন। দুজন মেঝেতে দুক কেটে রাখা ঘরের দু পাশে বসে খেলছে। তাদের পাশে আরো দুজন স্থির হয়ে বসে আছে। একজন করুণ বিষণ্ণ স্বরে গান। গাইছে। অন্যের দেয়ালে হেলান দিয়ে নিঃশব্দে বসে আছে।
সমস্ত দৃশ্যটি একটি পরাবাস্তব দৃশ্যের মতো।
ক্যাপ্টেন বৰ্কেন একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, আমি নীলমানদের বিশেষজ্ঞ নই কিন্তু তারপরও আমি বলতে পারি, এই দৃশ্যটি স্বাভাবিক নয়। এটি স্বাভাবিক হতে পারে না। একজন মানুষের মৃত্যুর সময়ে অন্যেরা এত নিস্পৃহ হতে পারে না। নীলমানব হলেও না।
নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান ক্রুশ বললেন, দৃশ্যটি অস্বাভাবিক হতে পারে মহামান্য ক্যাপ্টেন, কিন্তু এখানে তো কোনো ষড়যন্ত্রের আভাস নেই।
ক্যাপ্টেন বনে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে ক্রুশের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর শান্ত গলায় বললেন, এই দৃশ্যটিতে ষড়যন্ত্রের কোনো আভাস নেই আমার ধারণা সেটাই হচ্ছে ষড়যন্ত্র।
ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার লি বললেন, এই নীলমানবটিকে বাঁচানোর জন্য কী করা হবে মহামান্য ক্যাপ্টেন?
ক্যাপ্টেন বৰ্কেন মনিটরটির দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললেন, প্রথমে ঘরটিতে নিথিলিয়াম গ্যাল দেওয়া হবে। গ্যাসের বিক্রিয়ায় সবাই অচেতন হয়ে যাবার পর নিরাপত্তাকর্মীরা ঘরটিতে ঢুকবে। কবজি কেটে যে নীলমানবটি আত্মহত্যা করার চেষ্টা করছে, তাকে বের করে আনা হবে চিকিৎসা করার জন্য।
তাকে কি বাঁচানো সম্ভব হবে?
জানি না। শুনেছি নীলমানদের প্রাণশক্তি আমাদের প্রাণশক্তি থেকে অনেক বেশি। হয়তো বেঁচে যেতেও পারে।
নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান ক্রুশ বললেন, আমরা তা হলে কাজ শুরু করে দিই?
হ্যাঁ। শুরু করে দাও
ক্যাপ্টেন বৰ্কেনকে হঠাৎ কেন জানি ক্লান্ত দেখায়, তিনি ঘুরে অন্য সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, অ্যালার্মের শব্দ শুনে চলে আসার জন্য সবাইকে অনেক ধন্যবাদ। আমি সবাইকে সবকিছু জানিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম, যেন হঠাৎ করে আমরা আক্রান্ত হয়ে না পড়ি।
কমবয়সী মেয়েটি বলল, কিন্তু আমাদের তো এখন আক্রান্ত হবার কোনো আশঙ্কা নেই—তাই না?
ক্যাপ্টেন বৰ্কেন কোনো কথা না বলে অন্যমনস্কভাবে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান ক্রুশ মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললেন, না, কোনো আশঙ্কা নেই। এখন আপনারা সবাই নিজেদের কেবিনে কিংবা নিজেদের স্টেশনে ফিরে যেতে পারেন। ক্রুশ মাথা ঘুরিয়ে অন্যদের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার কমান্ডে যারা আছ, তারা আমার সাথে এস। সবাই নিজেদের অস্ত্রগুলো লোড করে বেখ। ।
মহাকাশচারীরা একজন একজন করে কন্ট্রোলরুম থেকে বের হয়ে যেতে শুরু করার পর ক্যাপ্টেন বৰ্কেন মনিটরের সামনে বড় চেয়ারটিতে বসলেন। হাত বাড়িয়ে সুইচ টিপে মনিটরটি চালু করে কার্গো বেতে দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপত্তাকর্মীদের দেখতে দেখতে অন্যমনস্কভাবে হাত দিয়ে টেবিলে শব্দ করতে লাগলেন।
মহামান্য ক্যাপ্টেন— গলার স্বর শুনে ক্যাপ্টেন বৰ্কেন মাথা ঘুরিয়ে দেখলেন রিরা তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।
ক্যাপ্টেন বৰ্কেন হালকা গলায় বললেন, কী ব্যাপার রিরা?
আমি কি আপনার সাথে এখানে কিছুক্ষণ থাকতে পারি?
এখানে থাকতে চাও?
জি মহামান্য ক্যাপ্টেন।
কেন?
রিরা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিচু গলায় বলল, আমাদের একাডেমিতে কয়েকটা কেস স্টাডি পড়ানো হয়েছিল, তার ভেতরে আপনার দুটো অভিযানের ঘটনা ছিল। আমি সেগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে বিশ্লেষণ করেছি। আমার মনে হয়েছে, কিছু কিছু বিষয়ে আপনার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আছে। গ্রিন গ্রহপুঞ্জে আপনি যেভাবে বিপদের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। সেটি রীতিমতো অলৌকিক।
কাপ্টেন বৰ্কেন কোনো কথা না বলে একটু হাসলেন। রিরা একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে বলল, আমার ধারণা নীলমানবদের ব্যাপারে আপনি যে আশঙ্কাটুকুর কথা বলেছেন, সেটা সত্যি প্রমাণিত হবে।
তোমার তাই ধারণা?
আমার নিজের কোনো ধারণা নেই মহামান্য ক্যাপ্টেন, আমার এই বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতাও নেই। কিন্তু আপনার সম্পর্কে আমি যেটুকু জানি, সেটা থেকে আমার ধারণা আপনার আশঙ্কা সত্যি প্রমাণিত হবে। নীলমানবেরা মহাকাশযান দখল করার চেষ্টা করবে। আমি আপনার কাছাকাছি থেকে পুরো ব্যাপারটি দেখতে চাই মহামান্য ক্যাপ্টেন। আপনি কীভাবে পুরো বিষয়টির অবসান ঘটান, আমি সেটা নিজের চোখে দেখতে চাই মহামান্য ক্যাপ্টেন।