ভারী গলার স্বরটি কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, তোমাদের পক্ষে যদি সম্ভব হয়
তা হলে আমাদের এই বার্তার প্রত্যুত্তর দাও। আবার বলছি, প্রত্যুত্তর দাও।
রিরা হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রিসিভারের উপর আঘাত করে নিজের হতাশাটা প্রকাশ করে। বলল, কেমন করে দেব? আমি খালি শুনতে পাই, বলতে পারি না।
রিসিভারে ভারী কণ্ঠস্বরটি বলল, যদি প্রত্যুত্তর দেবার মতো সুযোগ না থাকে তা হলেও কোনো সমস্যা নেই। আমাদের স্কাউটশিপে উদ্ধারকাজে ব্যবহৃত সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি রয়েছে, তারা নিশ্চিতভাবেই তোমাদের উদ্ধার করবে। স্কাউটশিপের দায়িত্বে আছে ক্যাপ্টেন বিহান, গ্রহটির কক্ষপথে পৌঁছেই সে তোমাদের সাথে যোগাযোগ করবে। ব্যাপ্টেন রিহান আমাদের সবচেয়ে কর্মদক্ষ তরুণ অফিসার। সে আমাদের মহাকাশযানের বারো জন দক্ষ এবং সশস্ত্র নিরাপত্তাকর্মীকে নিয়ে রওয়ানা দিয়েছে। আমি নিশ্চিত সে সাফল্যের সাথে তোমাদের উদ্ধার করতে পারবে। তোমাদের জন্য অনেক শুভ কামনা।
রিরা উতেজিত চোখে ইশানের দিকে তাকিয়ে বলল, শুনেছ কুশান, সবচেয়ে কর্মদক্ষ তরুণ অফিসার আসছে আমাদের উদ্ধার করতে?
কুশান মাথা নাড়ল, বলল, শুনেছি।
তোমার কী মনে হয় কুশান, আমরা কি তাদের অভ্যর্থনা করার জন্য কিছু ব্যবস্থা করে রাখব?
কুশান একটু হেসে বলল, তোমার মহাকাশ একাডেমি এ ব্যাপারে তোমাদের কোনো কোর্স দেয় নি?
রিরা মাথা নাড়ল, বলল, না। মজার ব্যাপার হচ্ছে কীভাবে উদ্ধার করতে যেতে হয়, সেটার ওপরে দুটি কোর্স নিয়েছিলাম, কিন্তু উদ্ধার করতে এলে কী করতে হয় তার ওপরে একটি কোর্সও দেয় নি।
কুশান বলল, ক্যাপ্টেন বিহান যখন এসে দেখবে তুমি জীবিত, সুস্থ এবং আনন্দে চিৎকার করছ, সে এত খুশি হবে যে সেটাই হবে তার অভ্যর্থনা।
রিরা মাথা নাড়ল, বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। একজন মানুষকে জীবিত উদ্ধার করতে পারাই খুব বড় একটা কাজ। মানুষের জীবন খুব বড় একটি ব্যাপার। অসম্ভব বড় একটি ব্যাপার। তাই না কুশান?
কুশান রিরার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল, তারপর ফিসফিস করে বলল, ঠিকই বলেছ। মানুষের জীবন খুব বড় একটি ব্যাপার।
ঘণ্টা দুয়েক পর গ্রহটির কক্ষপথ থেকে ক্যাপ্টেন বিহান একবার যোগাযোগ করে তার অবস্থানটি জানিয়ে দিল। কক্ষপথ থেকে রওয়ানা দিয়ে গ্রহটির বায়ুমণ্ডল ভেদ করে দ্বিতীয়বার যোগাযোগ করল আরো ঘণ্টাখানেক পর। এরপর সবকিছু ঘটতে লাগল খুব দ্রুত। তারা স্কাউটশিপটিকে মহাকাশযানের উপর দিয়ে গর্জন করে উড়ে যেতে দেখল, স্কাউটশিপটি বৃত্তাকার ঘুরে আবার তাদের কাছে ফিরে এল এবং বৃত্তটি ছোট করতে করতে একসময় মহাকাশযানের এক কিলোমিটারের কাছাকাছি একটি সমতল জায়গায় এসে অবতরণ করল। কোয়ার্টজের জানালা দিয়ে রিরা দেখল, উদ্ধারকারী দল নেমে আসছে। ছোটখাটো মানুষটি নিশ্চয়ই ক্যাপ্টেন রিহান, যোগাযোগ মডিউলে কথা বলতে বলতে সে তার দলটিকে প্রস্তুত করে নেয়। কিছু যন্ত্রপাতি, অস্ত্র, মেডিকেল টিম নিয়ে তারা দ্রুত মহাকাশযানটির দিকে ছুটে আসতে থাকে। রিরা হাত দিয়ে নিজের চুলগুলোকে বিন্যস্ত করে কুশানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কুশান, আমাকে কেমন দেখাচ্ছে?
কুশান হেসে বলল, আমি তোমাকে আগেও বলেছি, তোমার গায়ের রঙ যদি পচা আঙুরের মতো না হত, তা হলে তোমাকে সুন্দরী বলে চালিয়ে দেওয়া যেত।
আকাশের জন্য নীল রঙ ভালো হতে পারে কিন্তু গায়ের জন্য পচা আঙুরের রঙ কিন্তু খারাপ না!
সেটা নিয়ে বিতর্ক করার সময় আরো পাবে, তুমি এখন যাও, মহাকাশযানের দরজাটা খুলে দাও। তা না হলে তারা ভেঙে ঢুকে যাবে!
রিরা বলল, ঠিকই বলেছ। একেবারে সত্যি কথা।
রিরা দ্রুত মহাকাশযানের দরজার কাছে ছুটে গিয়ে তার হ্যান্ডেলটা ঘুরিয়ে সেটা খুলতে শুরু করে। কয়েক মিনিটের মাঝেই উদ্ধারকারী দলটি মহাকাশযানের ভেতরে ঢুকল, সবার আগে ক্যাপ্টেন রিহান, তার পিছনে সশস্ত্র লোকজন। ক্যাপ্টেন রিহান এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে রিরার দিকে তাকিয়ে বলল, এই মহাকাশযানটি যেভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে, তার ভেতরে কোনো জীবন্ত মানুষ খুঁজে পাব আমি একেবারে আশা করি নি।
রিরা তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আশার বাইরেও অনেক কিছু ঘটে যায়। উদ্ধার করতে আসার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
ক্যাপ্টেন রিহান হাত মিলিয়ে বলল, আমি রিহান। ক্যাপ্টেন রিহান।
আমি রিরা। আর–কুশানকে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য সে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল।
ঠিক তক্ষুনি সে একটা চিৎকার শুনতে পায়। কে একজন চিৎকার করে বলল, সর্বনাশ! নীলমানব।
কিছু বোঝার আগে রিরা বিস্ফারিত চোখে দেখতে পেল সশস্ত্র মানুষগুলো একসাথে তাদের অস্ত্রগুলো উপরে তুলেছে, একমুহূর্ত সময় লাগল তার ব্যাপারটি বুঝতে। যখন সে বুঝতে পারল তখন ভয়ংকর আতঙ্কে সে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠল, না—না–না–
কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। রিরার মনে হল তার চোখের সামনে অনন্তকাল নিয়ে মানুষগুলো অস্ত্রগুলো কুশানের দিকে তাক করেছে। মনে হল খুব ধীরে ট্রিগারে টান দিয়েছে। তার মনে হল লে বুলেটগুলোকে ছুটে যেতে দেখল। রিনার মনে হল সে দেখতে পেল একটি একটি বুলেট কুশানকে আঘাত করছে আর সেই আঘাতে তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। রিরার মনে হল সমস্ত সৃষ্টিজগৎ বুঝি থমকে দাঁড়িয়েছে, বুঝি সময় স্থির হয়ে গেছে। তার মনে হল কুশান বুঝি দুই হাতে দেয়াল আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছে—পারছে না। রির দেখল তার বুকের কাছাকাছি কাপড়ে বিন্দু বিন্দু নীল রঙের ছোপ, দেখল কুশানের চোখে এক ধরনের বিস্ময়। রিরা দেখল কুশান খুব ধীরে ধীরে হাঁটু ভেঙে পড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে তার মাঝে বুঝি অনন্তকাল পার হয়ে গেছে। রিরা ছুটে যেতে থাকে কুশানের কাছে মনে হয় সে বুঝি কখনোই আর তার কাছে পৌঁছতে পারবে না।