বন্ধ ঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছে বেশ কয়েকজন। একজন নিচু গলায় একটা গান গাইছে। গানের কথাগুলো বোঝা যায় না কিন্তু সুরটুকু খুব বিষণ্ণ এবং করুণ, বুকের ভেতর এক ধরনের হাহাকারের মতো অনুভূতি হয়। রিরা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে নীলমানবদের দলটির দিকে তাকিয়ে রইল। এই মানুষগুলো আসলে ভয়ংকর একরোখা, দুর্ধর্ষ এবং নৃশংস। কিন্তু চুপচাপ নিঃশব্দে বসে থাকতে দেখে সেটি একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। একাডেমিতে মানুষের এই অপভ্রংশ সম্পর্কে তাদেরকে পড়ানো হয়েছে, তাদের সম্পর্কে রিরার এক ধরনের বিচিত্র কৌতূহল ছিল, মনিটরে সরাসরি দেখতে পেয়ে সে বিস্ময়াভিভূত চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল।
রিরা তখনো জানত না তার জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটবে এই নীলমানবদের নিয়েই।
০২. তীক্ষ্ণ একটা অ্যালার্মের শব্দ
তীক্ষ্ণ একটা অ্যালার্মের শব্দ শুনে রিরা ঘুম থেকে জেগে উঠল। মহাকাশযানে এই অ্যালার্মটি একটি বিপদসংকেত। একাডেমিতে তাদের অনেকবার শোনানো হয়েছে। রিরা লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে তার কাপড় পরতে শুরু করে, জরুরি অবস্থার জন্য আলাদা করে রাখা ব্যাকপেকটা পেছনে ঝুলিয়ে সে দ্রুত দরজা খুলে বের হয়ে এল। মহাকাশযানের অন্যরাও ছুটতে ছুটতে যাচ্ছে, রিরা ভয় পাওয়া গলায় কমবয়সী একজনকে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে জান?
উহ জানি না। মানুষটি হাত দিয়ে পুরো ব্যাপারটি উড়িয়ে দেবার একটা ভঙ্গি করে বলল, আমার মনে হয় ড্রিল।
ড্রিল?
হ্যাঁ। মহাকাশযানে রওনা দেবার পর প্রথম প্রথম ইচ্ছে করে এরকম ড্রিল করানো হয়।
রিরা ছুটতে ছুটতে মহাকাশযানের কন্ট্রোলরুমে হাজির হয়ে দেখতে পেল, সেখানে এর মাঝে অন্য সবাই পৌঁছে গেছে। ক্যাপ্টেন বৰ্কেন বড় মনিটরটির দিকে চিন্তিত মুখে তাকিয়ে আছেন। তিনি মনিটরটি বন্ধ করে মাথা ঘুরিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি অ্যালার্ম বাজিয়ে সবাইকে ডেকে এনেছি—যদিও তোমাদের মনে হতে পারে ডেকে আনার প্রয়োজন ছিল না। তোমাদের মনে হতে পারে এটি মোটেও মহাকাশযানের একটি জরুরি ঘটনা নয়।
ক্যাপ্টেন বৰ্কেন চুপ করলেন এবং মধ্যবয়স্ক ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার লি জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে মহামান্য ক্যাপ্টেন?
তোমরা সবাই জান আমরা আমাদের এই মহাকাশযানে করে সতের জন নীলমানকে বিজ্ঞান একাডেমিতে নিয়ে যাচ্ছি। তোমরা নিশ্চয়ই এটাও জান যে নীলমানবেরা এই মহাজগতের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ এবং সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণী। আমি যদি তাদেরকে ঘুম পাড়িয়ে শীতলঘরে করে নিতে পারতাম, তা হলে স্বস্তিবোধ করতাম। কিন্তু বিজ্ঞান একাডেমির বিশেষ নির্দেশে আমরা তাদেরকে একটা ঘরে বন্ধ করে মুক্ত অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছি। ক্যাপ্টেন বৰ্কেন একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, আমার একটি সন্দেই ছিল যে, এরা নিশ্চয়ই কোনোভাবে এখান থেকে নিজেদের মুক্ত করে মহাকাশযানটি দখল করার চেষ্টা করবে।
ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার লি শঙ্কিত গলায় বললেন, তারা কি কিছু করেছে?
আমার ধারণা প্রক্রিয়াটি তারা শুরু করেছে।
উপস্থিত সবাই একসাথে চমকে উঠল। কমবয়সী একটা মেয়ে বলল, তারা কী করছে?
ক্যাপ্টেন বৰ্কেন একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, কিছুক্ষণ আগে একজন নীলমানব তার হাতের কবজির ধমনিটা কেটে ফেলেছে। তার শরীর থেকে নীল রক্ত বের হয়ে আসছে। কিছুক্ষণের মাঝেই এই নীলমানবটি মারা যাবে।
কমবয়সী মেয়েটা ছটফট করে বলল, কিন্তু এটা তো আত্মহত্যা। নীলমানবেরা নিজেরা আত্মহত্যা করে কেমন করে আমাদের মহাকাশযান দখল করবে?
ক্যাপ্টেন বর্কেন একটু হাসার চেষ্টা করে বললেন, নীলমানবেরা, যে ঘরটিতে আছে, সেটা বলা যেতে পারে একটা দুর্ভেদ্য ঘর, তার ভেতরে কারো যাবার কিংবা বের হবার ব্যবস্থা নেই। স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র দিয়ে তাদের খাবার দেওয়া হয়, তাদের বর্জ সরিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু এখন—
ক্যাপ্টেন বৰ্কেন একটু থামলেন—সবার দিকে একনজর দেখে বললেন, কিন্তু এখন এই দুর্ভেদ্য ঘরের দরজা আমাদের খুলতে হবে। নীলমানবের মানুষ নয়—তাই যে নীলমানরটি তার হাতের কবজি কেটে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করছে, তাকে বাঁচানোর আমাদের কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু বিজ্ঞান একাডেমি এদেরকে জীবন্ত পেতে চায়। আমাদের এখন একে বাচাতে চেষ্টা করতে হবে। এবং সেজন্য এখন আমাদের এই ঘরের দরজা খুলে ঢুকতে হবে।
মহাকাশযানের নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান ক্রুশ ভুরু কুঁচকে বললেন, মহামান্য ক্যাপ্টেন, আপনার ধারণা এই ঘরের দরজা খোলার জন্য নীলমানবটি আত্মহত্যা করেছে?
আমার তা-ই ধারণা।
তা হলে এর একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আছে। নীলমানবেরা সবাই মিলে এই পরিকল্পনাটি করেছে?
হ্যাঁ। নীলমানব বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করে না। তারা সব সময় একসাথে কাজ করে। এরা এক ধরনের সমন্বিত প্রাণসত্তা।
নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান ক্রুশ গম্ভীর মুখে বললেন, যদি তারা সত্যিই এটি পরিকল্পনা করে থাকে, তা হলে আমাদের সিকিউরিটি সিস্টেম সেটি জানবে। কারণ আমরা তাদের প্রত্যেকের প্রতিটি পদক্ষেপ মনিটর করছি। আমাদের সিকিউরিটি সিস্টেম কী বলছে?
ক্যাপ্টেন বৰ্কেন বললেন, সেটাই হচ্ছে সমস্যা। আমাদের মহাকাশযানের মূল সিকিউরিটি প্রসেসর যে রিপোর্ট দিয়েছে, সেখানে কোথাও কোনো ধরনের পরিকল্পনার কথা নেই। কোনো ষড়যন্ত্র নেই। নীলমানবেরা হালকা কথাবার্তা বলেছে, দাবা জাতীয় একটা খেলা খেলে সময় কাটিয়েছে, গান করেছে এবং বেশিরভাগ সময়ে কিছু না করে চুপচাপ ছাদের দিকে তাকিয়ে শুয়ে থেকেছে।