কুশান অবাক হয়ে দেখল রিরার চোখে পানি চিকচিক করছে। মানুষকে মনে হয় সে কখনোই পুরোপুরি বুঝতে পারবে না।
১২. তিতির পাখির মাংস
কুশান প্লেটের খাবারের টুকরোটা দেখে বলল, তুমি দাবি করছ এটা সত্যিকার তিতির পাখির মাংস?
রিরা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। খাবারের টিনে পরিষ্কার লেখা আছে এটা সত্যিকার তিতির পাখির মাংস।
কুশান শুকনো রুটির টুকরোগুলো দেখিয়ে বলল, আর এগুলো সত্যিকার যবের রুটি?
হ্যাঁ। এগুলো সত্যিকার যবের রুটি। বিশাল একটা মাঠে এটা জনেছে। এটা কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয় নি।
কুশান রুটির টুকরোর উপর মাখন লাগাতে লাগাতে বলল, আর এই মাখনটা সত্যিকারের মাখন?
সেটা নিয়ে একটু বিতর্ক আছে। দাবি করা হয় কৃত্রিম এবং সত্যিকারের মাখনের মাঝে এখন আর কোনো পার্থক্য নেই। কাজেই কোনটা সত্যি কোনটা কৃত্রিম বোঝার কোনো উপায় নেই।
কুশান রুটির টুকরোটা মুখে দিয়ে চিবুতে চিবুতে বলল, কিন্তু একটা জিনিস জান রিরা
কী?
আমি কিন্তু খাবার সময় সত্যিকার যবের রুটির সাথে কৃত্রিম যবের রুটির মাঝে। কোনো পার্থক্য খুঁজে পাচ্ছি না।
রিরা শব্দ করে হেসে বলল, এটা কাউকে বলো না, তা হলে সবাই তোমাকে ভাববে সাধারণ রুচির মানুষ। যাদের রুচি খুব উন্নত, তারা এই পার্থক্যগুলো ধরতে পারে।
কুশান বলল, তুমি বলেছিলে আমাদের এই ভোজের সময় আমরা কিহিতার সপ্তদশ সিম্ফনি শুনব।
হ্যাঁ। আমি সেটার ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু সেখানে একটা ব্যাপার আছে।
কী ব্যাপার?
সপ্তদশ সিম্ফনি শুনে যদি তোমার ভালো নাও লাগে, তুমি সেটা বলতে পারবে না।
কুশান চোখ বড় করে বলল, বলতে পারব না?
না। তুমি ভান করবে তোমার খুব ভালো লাগছে।
কেন?
রিরা চোখে-মুখে একটা গাম্ভীর্য ফুটিয়ে বলল, এই সিম্ফনিটি আমার খুব প্রিয়। কেউ এটাকে অপছন্দ করলে আমিও তাকে অপছন্দ করি।
কুশান তিতির পাখির মাংসের ছোট টুকরো মুখে দিয়ে হাসতে হাসতে বলল, তুমি নিশ্চিন্ত থাক রিরা, তুমি যেটাকে ভালো বলবে আমি সেটাকে কখনো খারাপ বলব না। দরকার হলে আমার চোখ-কান বন্ধ করে আমি সেটাকে ভালো বলব।
ঠিক তো?
ঠিক।
রিরা গলা উঁচু করে বলল, প্রসেসর?
প্রসেসর তার নিষ্প্রাণ ধাতব কণ্ঠে বলল, বলো রিরা।
কিহিতার সপ্তদশ সিম্ফনিটা শুরু করে দাও।
খুব সূক্ষ্ম একটা সঙ্গীতের ধ্বনি ভেসে এল, প্রায় শোনা যায় না এরকম। আস্তে আস্তে সেটি ঘরের ভেতরে অনুরণিত হতে থাকে। মহাকাশের মাঝে যে বিশাল শূন্যতা, যে তীব্র নিঃসঙ্গতার বেদনা, সেটি যেন বুকের ভেতর হাহাকার করে যেতে থাকে। মনে হতে থাকে এই জগৎ, এই জীবন, এই বেঁচে থাকা সবকিছু মিথ্যে, সবকিছু অর্থহীন।
সিম্ফনিটা শেষ হবার পরও দুজন অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। রিরা নিজের চোখ মুছে জোর করে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, আমি আসলে খুব আবেগপ্রবণ, অল্পতেই খুব কাতর হয়ে যাই। তবে সেটা কখনো কাউকে দেখাই নি। মহাকাশ একাডেমিতে সবাই জানত আমি খুব শক্ত একটি মেয়ে!
আমার মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়েও যেদিন তুমি ট্রিগার টান নি, আমি সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম যে তোমার ভেতরটা খুব নরম।
আর কী বুঝেছিলে?
আর বুঝেছিলাম তুমি—
আমি?
তুমি হয়তো জীবনে কষ্ট পাবে।
রিরা একটু অবাক হয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখন মূল প্রসেসর বলল, রিরা।
বলো।
এইমাত্র একটা উদ্ধারকারী মহাকাশযান থেকে আমাদের সাথে যোগাযোগ করেছে।
রিরা চিৎকার করে উঠে দাঁড়াল, ছুটে গিয়ে কুশানকে জড়িয়ে ধরে বলল, শুনেছ? কুশান শুনেছ? আমাদের জন্য উদ্ধারকারী মহাকাশযান আসছে।
কুশীন মাথা নাড়ল, বলল, শুনেছি।
রিরা জিজ্ঞেস করল, প্রসেসর? কী বলছে উদ্ধারকারী মহাকাশযান?
এখনো কিছু বলে নি। তারা মহাকাশযানের আইডি কোড এসব মিলিয়ে নিচ্ছে। কিছুক্ষণের মাঝে সরাসরি যোগাযোগ করবে। কিন্তু–
কিন্তু কী?
তুমি শুধু তাদের কথা শুনতে পাবে। তাদেরকে কিছু বলতে পারবে না।
হ্যাঁ। রিরা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, এখানে আমরা একটা দুর্বল রিসিভার দাঁড় করিয়েছি কিন্তু আমাদের ট্রান্সমিটার ত্রিশ কিলোমিটার দূরে।
কুশান বলল, আমার মনে হয় সেটা কোনো বড় সমস্যা নয়। যখন সামনাসামনি দেখা হবে তখন তোমার ট্রান্সমিটার আর রিসিভার কিছুই লাগবে না!
রিরা মাথা নাড়ল, বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। তারপর হাত নেড়ে উত্তেজিত গলায় বলল, আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে, সত্যি সত্যি আমাদের উদ্ধার করতে চলে আসছে! কী আশ্চর্য! তাই না কুশান?
কুশান খুব ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। রিরা উত্তেজিত হয়েছিল বলে লক্ষ করল না মাথা নাড়ার সময় কুশান খুব সাবধানে একটি দীর্ঘশ্বাস গোপন করেছে।
রিসিভারের কাছে সারাক্ষণ বসে থাকার প্রয়োজন নেই, তারপরেও রিরা কমিউনিকেশান ঘরে ধৈর্য ধরে বসে বইল। প্রাথমিক যোগাযোগের প্রায় তিন ঘণ্টা পর রিরা প্রথমবার উদ্ধারকারী দলের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল। মহাকাশযানের ক্যাপ্টেন ভারী গলায় বললেন, মহাকাশযান ভেগা সাত সাত তিন চারের বেঁচে থাকা মহাকাশচারীদের উদ্দেশে বলছি। আমি আবার বলছি মহাকাশযান ভেগা সাত সাত তিন চারের অভিযাত্রীরা, আমরা তোমাদের পাঠানো জরুরি উদ্ধারবার্তা পেয়েছি। আবার বলছি, জরুরি উদ্ধারবার্তা পেয়েছি। তোমাদের বার্তা মূল মহাকাশ কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে, সেখান থেকে আমাদের জরুরি বার্তা। পাঠিয়ে তোমাদের উদ্ধার করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমি আবার বলছি, তোমাদের উদ্ধার করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমি তাই আমার মহাকাশযানের গতিপথ একটু পরিবর্তন করে এদিকে এসেছি। আমাদের একটা স্কাউটশিপ তোমাদের উদ্ধার করার জন্য রওয়ানা দিয়েছে। কিছুক্ষণের মাঝে সেটা এই গ্রহটির কক্ষপথে পৌঁছে যাবে। স্কাউটশিপ থেকে জানানো হয়েছে তারা তোমাদের বিধ্বস্ত মহাকাশযানটি খুঁজে পেয়েছে এবং গ্রহে অবতরণ করেই সেখানে পৌঁছে যাবে।