পারতে হবে। অন্ধকারে কুশানের চাপা গলার স্বর শোনা গেল, যেভাবে হোক। পারতে হবে।
আমাদের ভাগ্য আমরা খরচ করে ফেলেছি কশান।
এখনো খরচ হয় নি। রিরা হঠাৎ অনুভব করল, কুশান তাকে টেনে দাঁড় করিয়েছে, আমার অংশের ভাগ্যটুকু আমি তোমাকে দিচ্ছি। এখন তোমার কাছে দুজনের ভাগ্য।
কী বলছ তুমি?
ঐ যে সামনে তাকিয়ে দেখ—আমাদের মহাকাশযানটা দেখতে পাচ্ছ?
রিরা আবছাভাবে দেখতে পেল, বলল, হ্যাঁ।
তুমি সেদিকে যেতে শুরু কর। যেভাবে পার। দৌড়িয়ে হেঁটে হামাগুড়ি দিয়ে।
আর তুমি?
আমি আসছি তোমার পিছু পিছু তোমাকে কাভার দিয়ে।
তুমি কীভাবে কাভার দেবে?
আমার কাছে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র আছে। আমি আগুন জ্বালাব।
তুমি কীভাবে আগুন জ্বালাবে? এখানে অক্সিজেন নেই।
আছে, আমার কাছে অক্সিজেন আছে।
রিরা চমকে উঠে বলল, কিন্তু সেটা নিশ্বাস নেবার অক্সিজেন।
সেটা নিয়ে কথা বলার সময় নেই। প্রাণীগুলো চলে আসছে। আমি দেখতে পাচ্ছি রিরা আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
না। আমি একা যাব না।
তোমাকে যেতে হবে। তোমাকে যেভাবে হোক বেঁচে থাকতে হবে। তোমাকে উদ্ধার করতে আসবে মনে নেই?
না–রিরা চিৎকার করে বলল, না।
হ্যাঁ। কুশান রিরাকে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল, যাও। তাড়াতাড়ি।
রিরা কুশানের পদশব্দকে মিলিয়ে যেতে শুনল। কোথায় গিয়েছে সে?
ভয়ংকর হিংস্র শব্দ শুনতে পাচ্ছে সে। সমুদ্রের জলোচ্ছাসের মতো হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ প্রাণী ছুটে আসছে তাদের দিকে। রিরা আর চিন্তা করতে পারছে না। কোনোভাবে সে উঠে দাঁড়াল, তারপর একপায়ে ভর দিয়ে ছুটে যেতে শুরু করল মহাকাশযানের দিকে। পায়ের নিচে শক্ত পাথর, অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে সে এই পাথরের উপর দিয়ে হেঁটে যায়। তাকে ঘিরে হিংস্র জন্তুগুলি ছুটে যাচ্ছে, খুব কাছে থেকে ভয়ংকর গলায় ডেকে উঠছে হঠাৎ হঠাৎ। রিরা কিছু দেখতে পাচ্ছে না, অন্ধকারে হঠাৎ কোথা থেকে তার উপরে কিছু ঝাঁপিয়ে পড়বে এরকম একটা আতঙ্কে তার সমস্ত মায়ু টানটান হয়ে আছে। যন্ত্রণা আর পরিশ্রমে তার সমস্ত শরীর অবসন্ন হয়ে আসতে চাইছে। প্রচণ্ড তৃষ্ণয় বুকটা ফেটে যেতে চাইছে, তার মাঝে সে মহাকাশযানের দিকে ছুটে যেতে লাগল।
হঠাৎ করে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলির শব্দ শুনল সে ছাড়া ছাড়াভাবে, সাথে সাথে ভয়ংকর প্রাণীগুলোর হিংস্র চিৎকার বেড়ে গেল কয়েকগুণ হুঁটোপুটি শুরু হয়ে গেল কোথাও। রিরা নিজেকে টেনে নিতে থাকে সামনে, মহাকাশযানের একেবারে কাছাকাছি এসে গেছে সে, আর কয়েক পা গেলেই পৌঁছে যাবে রিরা।
আবার গুলির শব্দ শুনতে পেল, তাকে কাভার দিচ্ছে কুশান। বলেছিল তার ভাগ্যটুকু সে রিরাকে দিয়ে দিচ্ছে—সত্যিই কি একজনের ভাগ্য আরেকজনকে দেওয়া যায়? সত্যিই কি স্বার্থপরের মতো কুশানের ভাগ্যটুকু নিয়ে এসেছে সে? রিরা মহাকাশযানের দরজায় হাত দেয়, গোপন সংখ্যা প্রবেশ করাতেই ঘরঘর শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল। ভেতরে ঢুকে টেনে দরজাটা বন্ধ করে দিতেই মূল প্রসেসরের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল, জীবাণুমুক্ত করার জন্য বাতাস শোধনের প্রক্রিয়া শুরু করতে যাচ্ছি—
বাইপাস কর।
এটি হবে অত্যন্ত অযৌক্তিক নিরাপত্তাবহির্ভূত কাজ।
রিরা চিৎকার করে বলল, আমি যা বলছি তা-ই কর।
বাইরের বাতাস ভেতরে ঢুকে সমস্ত মহাকাশযান দূষিত হয়ে যেতে পারে, ভয়ংকর বিপর্যয় হয়ে যেতে পারে।
রিরা দরজায় লাথি দিয়ে বলল, আহাম্মক, খুন করে ফেলব আমি। দরজা খোল।
নিরাপত্তার সব নিয়ম ভঙ্গ করে, ঘরঘর করে মহাকাশযানের মূল দরজা খুলে গেল। রিরা মহাকাশযানের ভেতরে ঢুকে ছুটতে থাকে, তার এখন একটা ফ্লেয়ার দরকার, জরুরি নিরাপত্তার জন্য সে অনেকগুলো আলাদা করে রেখেছে।
ফ্লেয়ারটা হাতে নিয়ে রিরা যখন বাইরে ছুটে যাচ্ছিল, তখন সে আবার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলির শব্দ শুনতে পেল, এবারে থেমে থেমে একটানা গুলি হতে লাগল। কুশানকে নিশ্চয়ই আক্রমণ করেছে প্রাণীগুলো নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে সে। দূরে একটা আগুন জ্বলছে আগুনটা নড়ছে ইতস্তত, কুশান আগুন দিয়ে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করছে প্রাণীগুলোকে, আগুনকে ঘিরে ছায়াকে সে ছুটোছুটি করতে দেখে, ভয়ংকর হিংস্র কিছু ছায়া।
ফ্লেয়ারটার সুইচ টিপে ছেড়ে দিতেই আগুনের একটা হলকা বের হয়ে গর্জন করে সেটা আকাশে উঠে গেল, মহুর্তে দিনের মতো আলোকিত হয়ে উঠল চারদিক। সাথে সাথে হিংস্র প্রাণীগুলো কাতর আর্তনাদ করে ছুটে পালিয়ে যেতে শুরু করে। ভয়ংকর হুঁটোপুটি শুরু হয়ে যায় চারদিকে। রিরা চোখ কুঁচকে তাকাল সামনে, একটা বড় পাথরে হেলান দিয়ে বলে আছে কুশান, নিজের কাপড় খুলে সেটাতে আগুন ধরিয়েছে, নিশ্বাস নেবার অক্সিজেন দিয়ে আগুনটা জ্বালিয়ে রেখেছে কোনোভাবে।
রিরা ছুটে গেল কুশানের কাছে, সমস্ত শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে, ধারালো দাঁত দিয়ে খুবলে নিয়েছে তার ডান হাতের একটা অংশ। নীল রক্তে ভিজে যাচ্ছে শুকনো পাথর। রিরাকে দেখে কুশান দুর্বলভাবে হাসল, বলল, তুমি এসেছ?
হ্যাঁ কশান, আমি এসেছি।
বেঁচে গেলাম তা হলে আমরা?
হ্যাঁ, কুশান। তোমার জন্য। তুমি তোমার ভাগ্যটা আমাকে দিয়ে দিয়েছিলে বলে আমরা বেঁচে গেলাম।
ভাগ্য খুব বিচিত্র জিনিস কুশান নরম গলায় বলল, কাউকে দিয়ে দিলেও সেটা ফুরিয়ে যায় না।
রিরা নিচু হয়ে কুশানকে স্পর্শ করল, তারপর গভীর মমতায় তার মাথাটিকে নিজের বুকে চেপে ধরল। ফিসফিস করে বলল, কুশান, আমার ভাগ্য ফুরিয়ে গিয়েছিল, আমার জীবনও ফুরিয়ে গিয়েছিল! তুমি সবকিছু ফিরিয়ে এনেছ। তুমি!