কী হল?
আমি কোনদিকে যাব বুঝতে পারছি না।
তুমি ঠিক দিকেই যাচ্ছ রিরা। একটু বাম দিকে ঘুরিয়ে নাও-দশ ডিগ্রির মতো।
ফ্লেয়ারের আলোতে সবকিছু অন্যরকম লাগছে—আলোটা উপর থেকে আসছে, কোনো ছায়া নেই, তাই কোনো কিছুর গভীরতা বুঝতে পারছি না।
আমি বুঝতে পারছি রিরা। তুমি মাথা ঠাণ্ডা রাখ ঘাবড়ে যাবার কিছু নেই।
পাথরগুলো কত উঁচুতে বুঝতে পারছি না—মনে হচ্ছে কোথাও ধাক্কা লাগিয়ে দেব।
না রিরা। কুশান শান্ত গলায় বলল, তুমি ধাক্কা লাগাবে না।
ফ্লেয়ারটা ধীরে ধীরে নেমে আসছে। এটা যত নিচে নামছে আলোর তীব্রতা তত বাড়ছে—শুধু যে আলোর তীব্রতা বাড়ছে তা নয়, ফ্লেয়ারটি নামছে সামনের দিকে, তাই রিরার চোখ ধাধিয়ে যাচ্ছে। পুরো এলাকাটি হঠাৎ মনে হতে থাকে একটা বিশাল সাদা পরদার মতো। রিরা দাতে দাঁত চেপে বলল, আর পারছি না, চোখ ধাধিয়ে যাচ্ছে।
কুশান কোনো কথা বলল না। রিরা জিজ্ঞেস করল, প্রাণীগুলো কোথায় আছে কুশান?
আমাদের ঘিরে রেখেছে। ফ্লেয়ারটা নিভে গেলেই ছুটে আসবে আমাদের দিকে।
সর্বনাশ!
হ্যাঁ রিরা, কাজেই যেভাবে হোক আমাদের মহাকাশযানে পৌঁছাতে হবে। বুঝেছ?
বুঝেছি।
রিরা সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে বাইভার্বালটা চালিয়ে নিয়ে যেতে থাকে, কয়েকবার বিপজ্জনকভাবে দুটি পাথরের সাথে ধাক্কা লাগতে লাগতে শেষমুহূর্তে নিজেদের বাঁচিয়ে নেয়। কুশান শান্ত গলায় বলল, মহাকাশযানটিকে দেখতে পাচ্ছি রিরা। আর মাত্র কিছুক্ষণ।
ঠিক আছে।
মাথা ঠাণ্ডা রাখ রিরা—
রিরা মাথা ঠাণ্ডা রাখল।
আজ ভাগ্য আমাদের পক্ষে, আজ আমাদের কোনো বিপদ হতে পারে না।
রিরা বিশ্বাস করতে চাইল আজ ভাগ্য তাদের পক্ষে। আজ সত্যিই বিপদ হবে না।
কিন্তু শেষমুহূর্তে ভাগ্য তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল। ফ্লেয়ারটি যখন খুব নিচে নেমে এসেছে, তীব্র আলোতে যখন কিছু দেখা যাচ্ছে না, তখন রিরা বাইভার্বালটিকে একটা বড় পাথরের পাশ দিয়ে ঘুরিয়ে নিতে গিয়ে অনুমানে ভুল করে ফেলল, বাইভার্বালটিসহ রিরা আর কুশান আছড়ে পড়ল শক্ত মাটিতে। বাইভার্বালের যন্ত্রপাতি, ফ্লেয়ার, অস্ত্র, সার্চলাইট, ব্যাটারি সবকিছু ছিটকে পড়ল চারদিকে, ঢালু পাথরে গড়িয়ে যেতে থাকল সিলিন্ডারের মতো ফ্লেয়ারগুলো।
চাপা গলায় একটা গালি দিয়ে রিরা উঠে দাঁড়ায়, পায়ের গোড়ালিতে ব্যথা লেগেছে, সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিল না সে। কুশান কাত হয়ে থাকা বাইভার্বালটা ধরে কোনোমতে উঠে দাঁড়াল, এক ধরনের হতচকিত দৃষ্টি দিয়ে চারদিকে তাকাল সে। রিরা কয়েক মুহূর্ত বেটার দিকে তাকিয়ে থাকে, তার ঔজ্জ্বল্য কমতে শুরু করেছে, বার কয়েক আলোটা কেঁপে কেঁপে উঠল, এটা নিভে যাবার সময় হয়েছে। রিরা ফিসফিস করে বলল, আমাদের ভাগ্যটুকু আমরা শেষ করে ফেলেছি কুশান।
কুশান চাপা গলায় বলল, ভাগ্য তৈরি করে নিতে জানলে কখনো শেষ হয় না।
তুমি জান তৈরি করতে?
জানতাম না। শিখছি।
কোথা থেকে শিখছ?
তোমার কাছ থেকে।
রিরা এত কষ্টের মাঝেও একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, আশা করি তুমি ভালো করে শিখেছ কুশান। কারণ আমি কিন্তু শিখি নি।
কুশান বাইভার্বালটাকে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল, এটা কি আর যাবে?
রিরা একনজর দেখে বলল, কিছুক্ষণ সময় ব্যয় করতে পারলে আবার চালানো যাবে।
কুশান চারদিকে একবার তাকিয়ে বলল, আমাদের সেই কিছুক্ষণ সময় নেই। প্রাণীগুলো ঘিরে ফেলেছে।
আরেকটা ফ্লেয়ার জ্বালানো যায় না?
না। ফ্লেয়ারগুলো গড়িয়ে নিচে চলে গেছে-এখন খুঁজে বের করার সময় নেই।
তা হলে?
আমার মনে হয় সবচেয়ে ভালো হবে যদি দৌড়ে মহাকাশযানের কাছে চলে যাই।
রিরা ফ্লেয়ারটির দিকে তাকাল, সেটা প্রায় নিবুনিবু হয়ে এসেছে, যে কোনো মুহূর্তে নিবে যাবে। জিজ্ঞেস করল, পৌঁছাতে পারব মহাকাশযানের কাছে?
পৌঁছাতে হবে।
কুশান নিচু হয়ে একটা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বলল, দেরি করে লাভ নেই রিরা। দৌড়াও।
কিন্তু—
এখন কিন্তুর সময় নেই। কুশান রিরাকে ধাক্কা দিয়ে বলল, দৌড়াও।
রিরা দৌড়াতে শুরু করেই হুঁমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। কুশান তার হাত ধরে বলল, কী হয়েছে রিরী?
কিছু না। পায়ে ব্যথা পেয়েছি।
রিরা আবার উঠে দাঁড়াল, পায়ের ব্যথা সহ্য করে সে কোনোভাবে দৌড়াতে চেষ্টা করতে থাকে, কুশান তার পিছু পিছু আসছে, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি হাতে নিয়ে সে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে চারদিকে।
ফ্লেয়ারটা হঠাৎ দপ করে নিবে গেল; অন্ধকার হয়ে গেল চারদিক—সাথে সাথে অসংখ্য প্রাণীর এক ধরনের হিংস্র ধ্বনি শুনতে পায় রিরা। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো এক ধরনের শব্দ ভেসে আসতে থাকে, ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিছু না দেখেও রিরা বুঝতে পারে ধারালো দাঁত বের করে অসংখ্য ক্লেদাক্ত প্রাণী হিংস্র নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে ছুটে আসছে তাদের দিকে।
রিরা ভয় পাওয়া গলায় বলল, আমি কিছু দেখছি না কুশান।
আমি দেখছি। আমাকে ধর।
রিরা হাত বাড়িয়ে কুশানকে ধরার চেষ্টা করল, কুশান এগিয়ে এসে রিরার হাত ধরে তাকে টেনে নিতে থাকে। একটু পরে পরে সে হুঁমড়ি খেয়ে পড়ে যেতে চায়, কিন্তু কুশান তাকে শক্ত করে ধরে রাখল, পড়ে যেতে দিল না। হিংস্র চিৎকার আর গর্জন বাড়ছে চারদিকে—পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছে স্পষ্ট। অন্ধকারে একটা পাথরে হোঁচট খেয়ে রিরা হঠাৎ পড়ে গেল নিচে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ছোট একটা আর্তচিৎকার করে ওঠে সে দাতে দাঁত চেপে যন্ত্রণাটা সহ্য করে ওঠার চেষ্টা করতে গিয়ে আবার হুঁমড়ি খেয়ে পড়ে গেল সে। কাতর গলায় বলল, আমি আর পারছি না কুশান।