কুশান জিজ্ঞেস করল, তুমি পারবে?
পারার কথা, মহাকাশ একাডেমিতে আমাদের শিখিয়েছে।
এটা কিন্তু অনেক পুরোনো সিস্টেম।
তা হলেও ক্ষতি নেই। জরুরি অবস্থার কোড কখনো পরিবর্তন করা হয় না। আমাদেরকে সেটাই শিখিয়েছে।
কিছুক্ষণের মাঝেই রিরা আবিষ্কার করল তাদেরকে ভুল জিনিস শেখানো হয় নি। জরুরি অবস্থার কোড ব্যবহার করে সে সত্যি সত্যি কিছুক্ষণের মাঝে ট্রান্সমিটারটা প্রোগ্রাম করে ফেলল। প্রতি সেকেন্ডে একবার করে ট্রান্সমিটারটা মহাকাশে সবাইকে জানিয়ে দিতে লাগল—বিধ্বস্ত মহাকাশযানের মহাকাশচারী এই গ্রহে আটকা পড়ে আছে, তাদেরকে উদ্ধার করার জন্য এস। এই তথ্যটি কাছাকাছি সব মহাকাশযান থেকে রিলে করা হবে—এক-দুই দিনের ভেতরে মূল মহাকাশ কেন্দ্রে তথ্যটি পৌঁছে যাবে। তখন কেউ না কেউ তাকে উদ্ধার করতে আসবে। এটি এখন শুধু সময়ের ব্যাপার।
রিরা কন্ট্রোল প্যানেলে সিগন্যালের তীব্রতা নিশ্চিত করে ঘুরে কুশানের দিকে তাকিয়ে বলল, কাজ শেষ।
পুরোপুরি শেষ হয় নি। আমরা মহাকাশযানে ফিরে যাবার পর বলব, কাজ শেষ।
হ্যাঁ। রিরা মাথা নাড়ল, বলল, মহাকাশযানে গিয়ে আমরা আজকে সত্যিকারের তিতির পাখির মাংস আর যবের রুটি দিয়ে একটা ভোজ দেব। তার সাথে থাকবে আঙুরের
রস।
খাবার পর থাকবে বুনো স্ট্রবেরি দিয়ে তৈরি ফলের কাস্টার্ড।
হ্যাঁ, ফলের কাস্টার্ড। রিরা মাথা নেড়ে বলল, তারপর কিহিতার সপ্তদশ সিম্ফনি শুনতে শুনতে আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকব।
কুশান একটু হেসে বলল, আমার মনে হয় সেজন্য আমাদের সবচেয়ে প্রথম মহাকাশযানে ফিরে যেতে হবে। যত তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে পারব, তত তাড়াতাড়ি এই আনন্দোৎসব শুরু করা সম্ভব হবে।
তুমি ঠিকই বলেছ কুশান, আর দেরি করে লাভ নেই।
চলো যাই।
দূজনে বাইভার্বালে এসে ওঠে। শক্ত হাতে হ্যান্ডেল ধরে পা দিয়ে চাপ দিয়ে ইঞ্জিন চালু করে দিতেই বাইভার্বালটা একটা চাপা গর্জন করে মাটির উপরে ভেসে উঠল। রিয়া হ্যান্ডেলটা টেনে ধরতেই সেটা একটা ঝাকুনি দিয়ে ছুটে যেতে থাকে।
রির দিগন্তে ঝুলে থাকা অতিকায় উপগ্রহটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অন্যমনস্কভাবে বলল, মহাকাশে পৌঁছানোর আগে হঠাৎ যদি গ্রহটা অন্ধকার হয়ে যায়, তা হলে কী হবে কুশান?
কিছুই হবে না রিরা, আমরা তার জন্য প্রস্তুত হয়ে এসেছি।
আমাদের মহাকাশ একাডেমিতে কী শিখিয়েছিল জান?
কী?
একজন মানুষ কখনোই একটা বিপদের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হতে পারে না। সেটার জন্য প্রস্তুত হওয়া সম্ভব কখন, জান?
কুশান রিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, কখন?
সেই বিপদটিতে পড়ে তার থেকে একবার উদ্ধার পেলে।
কুশান কোনো কথা না বলে দূরে উপগ্রহটির দিকে তাকিয়ে রইল। রিরা বলল, কী। হল কুশান, তুমি চুপ করে আছ কেন?
কুশান রিরার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, মহাকাশযানে পৌঁছতে আমাদের আর কতক্ষণ লাগবে রিরা?
এখনো কমপক্ষে আধাঘণ্টা। কেন?
আমার মনে হয় গ্রহটায় অন্ধকার নেমে আসতে শুরু করেছে।
রিরা ভয় পাওয়া গলায় বলল, তুমি কী বলছ কুশান?
হ্যাঁ। তাকিয়ে দেখ।
রিরা তাকিয়ে দেখল গাঢ় একটি অন্ধকার ছায়া উপগ্রহটি ঢেকে ফেলতে শুরু করেছে। অশুভ একটি অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে পুরো গ্রহটি। কোথা থেকে শীতল একটি বাতাস ভেসে এল, শিউরে উঠল রিরা, শীতে এবং আতঙ্কে।
কিছু বোঝার আগেই গাঢ় অন্ধকারে চারদিক ঢেকে গেল।
১১. বাইভার্বালটি থামিয়ে রিরা বলল
বাইভার্বালটি থামিয়ে রিরা বলল, আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না কুশান। তুমি দেখতে পাচ্ছ?
হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি।
চমৎকার। এই নাও-বাইভার্বালটা তুমি চালিয়ে নিয়ে যাও।
রিরা, আমি কখনো তোমাদের এই ভাসমান যান চালাই নি। কেমন করে চালাতে হয় আমি জানি না।
ঘুটঘুটে অন্ধকারে রিরা কুশানের দিকে তাকানোর চেষ্টা করল, সে কখনো কল্পনা করে নি যে, একজন বলতে পারে যে সে বাইভার্বাল কীভাবে চালাতে হয় জানে না। মানুষ যেভাবে হাঁটতে শেখে, সেভাবে বাইভার্বাল চালাতে শেখে। রিরা ভুলে গিয়েছিল কুশান মানুষ নয়, কুশান নীলমানব। সে একটু অধৈর্য গলায় বলল, বাইভার্বাল চালানো খুব সোজা কুশান। হ্যান্ডেলটা টেনে ধরলেই চলে…।
জানি। তুমি চালিয়েছিলে, আমি লক্ষ করেছি। কিন্তু সবকিছুরই এক ধরনের ব্যালেন্স দরকার। আমি যদি চালাতে গিয়ে কোনো পাথরে ধাক্কা লাগিয়ে ফেলি খুব বড় বিপদ হয়ে যাবে।
তা হলে?
একটা ফেয়ার জ্বালানো যাক। ফেয়ারের আলোতে তুমি চালিয়ে নাও।
ঠিক আছে।
রিরা বাইভার্বালের জমাটবাধা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল এবং তার মাঝে বুঝতে পারল কুশান একটা ফ্লেয়ার এনে সুইচ টিপে ছেড়ে দিয়েছে। জ্বলন্ত আগুনের হলকা ছড়িয়ে ফ্লেয়ারটা আকাশে উঠে গেল। কয়েক মুহূর্ত পর পুরো এলাকাটা তীব্র সাদা আলোতে ভরে গেল। অন্ধকারে এতক্ষণ থাকার পর হঠাৎ করে এই তীব্র আলোতে রিরার চোখ ধাধিয়ে যায়, সে দুই হাতে চোখ ঢেকে আলোতে অভ্যস্ত হবার চেষ্টা করতে করতে হঠাৎ ঝড়ো বাতাসের মতো এক ধরনের শব্দ শুনতে পেল। ভয় পাওয়া গলায় বলল, ওটা কিসের শব্দ কুশান?
আমার মনে হয় মহাকাশের প্রাণী বের হয়ে আসছে। ভয়ংকর এক ধরনের আতঙ্কে হঠাৎ রিরার বুক কেঁপে ওঠে। সে কাঁপা হাতে বাইভার্বালের হ্যান্ডেলটা ধরে নিজের দিকে টেনে আনে, একটা ছোট ঝাকুনি দিয়ে বাইভার্বালটা উড়ে যেতে শুরু করে। রিরা তীব্র আলোতে চোখ দুটোকে অভ্যস্ত হতে দিয়ে বাইভার্বালটাকে নিয়ন্ত্রণের মাঝে রাখার চেষ্টা করে। ফ্লেয়ারের কৃত্রিম আলোতে পুরো এলাকাটা এখন অপরিচিত একটা জগতের মতো দেখাচ্ছে, রিরার হঠাৎ করে দিক বিভ্রম হতে শুরু করল। কোনদিকে যাবে সেটা নিয়ে হঠাৎ তার ভেতরে একটা বিভ্রান্তির জন্ম হয়ে গেল। ভয় পাওয়া গলায় বলল, কুশান!