কুশান প্রত্যুত্তরে প্রায় চিৎকার করে বলল, কেন? এটাকে তুমি জুয়াখেলা কেন বলছ?
যদি হঠাৎ করে গ্রহটা অন্ধকার না হয়ে যায়, তা হলে পুরো কাজটা পানির মতো সহজ! আমরা বাইভার্বালে করে যাব, ট্রান্সমিটারে নতুন ব্যাটারি লাগাব, ট্রান্সমিটারে প্রোগ্রাম লোড করব এবং ফিরে আসব। কিন্তু যদি এর মাঝে গ্রহটা আবার অন্ধকার হয়ে যায়, তখন আমাদের কী অবস্থা হবে কল্পনা করতে পার?
কিন্তু আমরা তো তার প্রস্তুতি নিয়েছি। বেশ অনেকগুলো ফ্লেয়ার নিয়েছি, সার্চলাইট নিয়েছি, অস্ত্র নিয়েছি।
কিন্তু তুমি খুব ভালো করে জান এগুলো সত্যিকারের নিরাপত্তা না! আমরা যদি এই খোলা গ্রহে কয়েক লক্ষ বীভৎস প্রাণীর মুখোমুখি হয়ে যাই, তা হলে কোনোভাবে বের হয়ে আসতে পারব?
কুশান বলল, পারব, নিশ্চয়ই পারব।
কুশানের কথা শুনে বিারা কোনো উত্তর না দিয়ে মুখ টিপে হাসল।
কুশান জিজ্ঞেস করল, তুমি হাসছ কেন?
তুমি আমার উপদেশ মেনে মিছিমিছি আশা দিতে শুরু করে দেখে।
কুশান বলল, যেখানে ঠিক উত্তর জানা নেই, সেখানে মিছিমিছি আশা করে থাকা খারাপ নয়।
রিরা বাইভার্বালটাকে একটা বিপজ্জনক বড় পাথরের পাশ কাটিয়ে নিয়ে বলল, মানুষের বসতিটা আর কতদূর হবে বলে মনে হয়?
আমরা নিশ্চয়ই খুব কাছাকাছি চলে আসছি। আমার পাওয়ার মিটারে হাই ফ্রিকোয়েন্সির সিগন্যালটা বেশ জোরালো হয়ে গেছে।
রিরা বাইভার্বালটাকে কয়েক মিটার উপরে নিয়ে বলল, কুশান, তোমার দৃষ্টিশক্তি ঈগল পাখির মতো তুমি খুঁজে দেখ, দেখা যায় কি না।
কুশান সামনে তাকিয়ে বলল, আমার মনে হয় দেখতে পেয়েছি। সোজা সামনের দিকে যাও। একটা বিধ্বস্ত দালানের মতো দেখছি উপরে একটা এন্টেনা দেখা যাচ্ছে। আলোতে চকচক করছে।
রিরা দেখার চেষ্টা করে বলল, আমি কিছু দেখছি না।
আরেকটু কাছে গেলেই দেখবে।
সত্যি সত্যি কয়েক মিনিট পরেই রিরা মানুষের বসতিটা দেখতে পেল। ধুলায় ঢাকা পড়ে আছে কিন্তু দেখে বোঝা যায় একসময় এটি নিশ্চয়ই বেশ বড় একটা আবাসস্থল ছিল। একপাশে বড় বড় ডোম, দূরে পাওয়ার স্টেশন, মানুষের থাকার আবাসস্থল, পানির ট্যাংক–সবকিছুই ধুলার নিচে আড়াল হয়ে যেতে শুরু করেছে। রিরা বাইভার্বালটি নিয়ে পুরো এলাকাটা একবার ঘুরে এসে বলল, আর কিছুদিন পার হলে তো পুরোটাই বালুর নিচে ড়ুবে যেত, আর খুঁজেই পেতাম না।
কুশান বলল, খালিচোখে খুঁজে বের করা কষ্ট হত—ঠিক যন্ত্রপাতি থাকলে বের করা কঠিন কোনো ব্যাপার নয়।
রিরা বাইভার্বালটি মূল কেন্দ্রের কাছাকাছি থামিয়ে বলল, হ্যাঁ, সেটা ঠিকই বলেছ। আমাদের মহাকাশযানটা বিধ্বস্ত হয়ে আমরা মোটামুটিভাবে অনাথ হয়ে গেছি।
দুজন বাইভার্বাল থেকে নেমে কেন্দ্রটির দিকে তাকাল—সবকিছু ভেঙেচুরে বিধ্বস্ত হয়ে আছে। এই গ্রহের প্রাণীগুলো নিশ্চয়ই অসংখ্যবার এই কেন্দ্রটিতে এসে হানা দিয়েছে। রিরা। স্পষ্ট দেখতে পায়—মানুষের জ্বালানি শেষ হয়ে গেছে আর আলো জ্বালাতে পারছে না, অন্ধকার রাতে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মহাজাগতিক প্রাণী হিংস্র দাঁত নিয়ে ছুটে আসছে, মানুষকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলছে! কী ভয়ংকর একটি পরিণতি। রিরা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, চলো কুশান, ভেতরে যাই।
চলো। ভাঙা দেয়াল পার হয়ে তারা ভেতরে ঢুকল। ভেতরে আরো বেশি বিধ্বস্ত অবস্থা। ভাঙা যন্ত্রপাতি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে—নোংরা দেয়ালে পোড়া দাগ, ধসে যাওয়া ছাদ, দুমড়ে-মুচড়ে থাকা ধাতব টিউব—সব মিলিয়ে একটা ভয়ংকর পরিবেশ। রিরা নিচু গলায় বলল, এরকম একটা পরিবেশে ট্রান্সমিটারটা টিকে আছে কেমন করে? প্রাণীগুলো ট্রান্সমিটারটাকে নষ্ট করে নি কেন?
আমার মনে হয় কন্ট্রোল প্যানেলটি আলোকিত ছিল, আলো দেখে ভয় পেয়ে আসে
নি!
হ্যাঁ। তা-ই হবে নিশ্চয়ই। এখন এই জঞ্জালের ভেতরে খুঁজে পেলে হয়।
কুশান বলল, ভয় পেয়ো না। আমি খুঁজে বের করে ফেলব।
হ্যাঁ, কুশান। তুমি আর তোমার নীলমানবের দৃষ্টি এখন আমাদের একমাত্র ভরসা!
দুজনে মিলে খুঁজতে শুরু করে। বন্ধ ঘরের দরজা খুলে রিরা চিৎকার করে পেছনে। সরে আসে। ভেতরে একজন মানুষের মৃতদেহ পড়ে আছে কিছু কিছু অংশ ক্ষয়ে গেলেও চোখে-মুখে এখনো এক ধরনের অবর্ণনীয় আতঙ্ক। রিরা নিশ্বাস আটকে রেখে বলল, আমাদের যদি কেউ উদ্ধার করতে না আসে, তা হলে আমাদের এই অবস্থা হবে।
কুশান রিরাকে টেনে সরিয়ে নিয়ে এসে বলল, সেটা নিয়ে পরে দুশ্চিন্তা করা যাবে এখন যেটা করতে এসেছি, সেটা করা যাক।
ট্রান্সমিটারের কন্ট্রোল প্যানেলটা খুঁজতে গিয়ে তারা আরো কয়েকজন মানুষের মৃতদেহ এবং অনেকগুলো মৃতদেহের অংশবিশেষ খুঁজে পেল। এই গ্রহের প্রাণীগুলো এই মানুষগুলোকে তাদের ধারালো দাঁত দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছে। দেখে মনে হচ্ছে কেউ আত্মরক্ষার কোনো সুযোগ পায় নি।
ট্রান্সমিটারের কন্ট্রোল প্যানেলটি ছিল তিনতলার একটি ঘরে। কুশানের ধারণা সত্যি, প্যানেলটি আলোকিত বলে প্রাণীগুলো এটাকে কখনো স্পর্শ করে নি। দুজনে খুঁজে পুরোনো ব্যাটারিগুলো বের করে সেগুলো খুলে নতুন ব্যাটারি লাগিয়ে দিল। নতুন করে সুইচ অন করার সাথে সাথে কন্ট্রোল প্যানেলটি উজ্জ্বল আলোতে জ্বলে উঠল। রিরা হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলল, চমৎকার! এখন এটাকে যদি উদ্ধার করার জন্য প্রোগ্রাম করতে পারি, তা হলেই আমাদের কাজ শেষ।