কুশান বলল, না রিরা, বৃথা যায় নি।
কেন বৃথা যায় নি?
কুশান বলল, আমরা যদি ট্রান্সমিটার তৈরি করার জন্য অনেক পরিশ্রম করতাম, তা হলে বলতে পারতাম পরিশ্রমটা বৃথা গিয়েছে।
কেন কুশান? তুমি এটা কেন বলছ?
কারণ রিসিভারটি আমাদের কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা সিগন্যাল পেতে চাই —আমরা সিগন্যাল পাঠাতে চাই। সিগন্যাল পাঠাতে দরকার ট্রান্সমিটার!
রিরা শব্দ করে হেসে বলল, ঠিকই বলেছ। এখন চলো বিশ্রাম নিতে যাই। একদিনের জন্য অনেক পরিশ্রম হয়েছে।
কুশান বলল, তুমি যাও। আমি আরো কিছুক্ষণ দেখি।
বেশ। দেখি তুমি একটা ট্রান্সমিটার দাঁড় করাতে পাব কি না। এই ভয়ংকর প্রাণীগুলো আমাদের খেয়ে ফেলার আগে আমাদের যে করে হোক একটা ট্রান্সমিটার দাঁড় করাতে হবে। যে করেই হোক!
রিরা ঘুম থেকে উঠে কুশানকে খোঁজ করতে গিয়ে আবিষ্কার করল, সে এখনো কমিউনিকেশান কক্ষে বসে আছে। রিরা অবাক হয়ে বলল, সে কী! তুমি ঘুমাতে যাও নি?
যাব।
কী করছ এখানে একা একা বসে?
রিসিভারটার সার্কিট আবার পরীক্ষা করে দেখছিলাম।
পরীক্ষা করে কী দেখলে?
মনে আছে, রিসিভারটি ঠিক করে কাজ করছিল না? এক ধরনের পজিটিভ ফিডব্যাক হয়ে একটু পরে পরে বিপ বিপ শব্দ করছিল?
হ্যাঁ, মনে আছে।
আমি তাই সার্কিটটা পরীক্ষা করে দেখলাম। সার্কিটটা ঠিকই আছে। রিসিভারটা আসলে ঠিকভাবেই কাজ করছে।
রিরা ভুরু কুঁচকে বলল, বিপ বিপ শব্দ বন্ধ হয়েছে?
কুশান রিরার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। বলল, না, বন্ধ হয় নি।
তা হলে?
এই বিপ বিপ শব্দটা আসলে সত্যিকার সিগন্যাল। এটা এই গ্রহ থেকেই আসছে।
কী বলছ তুমি?
হ্যাঁ, আমি পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়েছি। এখান থেকে প্রায় ষাট কিলোমিটার দূর থেকে আসছে।
কে পাঠাচ্ছে এই সিগন্যাল?
কেউ পাঠাচ্ছে না। কুশান মাথা নেড়ে বলল, আগে এই গ্রহে মানুষেরা থাকত, এটা সম্ভবত তাদের ট্রান্সমিটার। নিজে থেকে কাজ করছে। ব্যাটারি দুর্বল, তাই সিগন্যালটাও খুব দুর্বল।
রিরা চোখ বড় বড় করে তাকাল, সত্যি বলছ তুমি?
আমার তা-ই ধারণা।
তার মানে ইচ্ছে করলে আমরা সেই ট্রান্সমিটারটা ব্যবহার করতে পারব?
হ্যাঁ, আমরা যদি এই গ্রহে ষাট কিলোমিটার ভ্রমণ করে ট্রান্সমিটারে নতুন ব্যাটারি লগিয়ে আসি তা হলে আমরা নিশ্চয়ই ব্যবহার করতে পারব।
আমরা তা হলে আমাদের অবস্থান জানিয়ে সিগন্যাল পাঠাতে পারব? উদ্ধারকারী কোনো মহাকাশযান এলে আমাদেরকে উদ্ধার করবে?
কুশান নরম গলায় বলল, এটি এখন প্রায় নিশ্চিত একটি সত্যিকারের সম্ভাবনা।
রিরা আনন্দে চিৎকার রে কুশানকে জড়িয়ে ধরল, কুশান একটু বিব্রত হয়ে বলল, আমি মানুষের মতো আনন্দ প্রকাশ হতে পারি না। একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরলে কী করতে হয়?
রিরা কুশানকে জড়িয়ে ধরে রেখে বলল, যদি সেটা তুমি না জান, তা হলে তোমাকে এখন আর শেখানো সম্ভব নয়।
তবু আমি জানতে চাই…
তোমার জানার প্রয়োজন নেই কশান। তোমরা নীলমানবের আনন্দ-ভালবাসা। এইসব ব্যাপার প্রকাশ করতে চাও না। আমরা মানুষেরা দরকার না থাকলেও প্রকাশ করে ফেলি।
আমি সেটা লক্ষ করেছি।
কাজেই যখন আনন্দ এবং ভালবাসা প্রকাশ করার প্রয়োজন হবে, আমি এখন থেকে দ্বিগুণ প্রকাশ করব। আমার এবং তোমার দুজনেরটা একসাথে মিলিয়ে।
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ রিরা।
রিরা কুশানকে ছেড়ে দিয়ে বলল, এবারে তুমি ওঠো। গিয়ে টানা একটা লম্বা ঘুম দাও। আমি জানি মানুষ কিংবা নীলমানব কেউই ঘুম ছাড়া ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না।
কুশান উঠে দাঁড়াল, রিরার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি আমার নিজের ভেতরে একটা বিচিত্র জিনিস লক্ষ করছি।
কী লক্ষ করছ কুশান?
আমার নিজের খুশি হওয়া এবং আনন্দ হওয়া নির্ভর করে তোমার ওপরে। তোমাকে খুশি হতে দেখলে আমিও খুশি হয়ে যাই। তোমার মন খারাপ হলে আমারও মন খারাপ হয়ে যায়।
রিরা একটু অবাক হয়ে কুশানের দিকে তাকাল। দুর্ধর্ষ এবং একরোখা এই নীলমানব প্রজাতির একজনের মুখে এরকম সহজ-সরল স্বীকারোক্তি রিরা কখনো আশা করে নি। সে একটু চেষ্টা করে মুখে সহজ একটা ভঙ্গি ফুটিয়ে বলল, এখন তা হলে আমার ওপর দায়িত্ব বেড়ে গেল! তোমাকে হাসিখুশি রাখার জন্য আমাকেও হাসিখুশি থাকতে হবে!
কুশান তার ঝকঝকে সাদা দাঁত বের করে হেসে বলল, তুমি মোটামুটিভাবে নিখুঁত শুধু যদি তোমার গায়ের রঙটা পচা আঙুরের মতো বাদামি না হত, তা হলে তোমাকে নিখুঁত বলা যেত!
রিরা শব্দ করে হেসে বলল, ঠিক আছে কুশান, আমি এটা একটা প্রশংসা হিসেবে নিচ্ছি!
আমি প্রশংসা হিসেবেই বলেছি। কুশান অপরাধীর মতো বলল, আমরা কিছু কিছু বিষয় ঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারি না।
কুশান ঘুমাতে চলে যাবার পর রিরা কমিউনিকেশান কক্ষে রিসিভারটির সামনে গিয়ে বসে। মূল প্রসেসরের সাথে কথা বলে তার দেখতে হবে—এখানে মানুষের আগের বসতিটি কোথায় ছিল, কেমন ছিল সেগুলো জানে কি না। এক-দুদিনের মাঝেই তাদের সেই বসতিতে যেতে হবে ট্রান্সমিটারের ব্যাটারিটি বদলে দিয়ে চালু করে দেবার জন্য।
রিসিভারের সুইচে হাত দিয়ে হঠাৎ করে রিরা একটু আনমনা হয়ে যায়, কী জন্য সে ঠিক বুঝতে পারে না।
১০. চাপা একটা গর্জন
চাপা একটা গর্জন করে মাটি থেকে মিটাবখানেক উপর দিয়ে বাইভার্বালটা উড়ে যাচ্ছে। বাইভার্বালের সামনে রেলিঙে হাত রেখে রিরা আর কুশান পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। গরম বাতাসের হলকায় তাদের চুল উড়ছে, গ্রহের সাদা বালিতে দুজনের চেহারাই ধূলি ধূসরিত। রিরা বলল, পুরো ব্যাপারটা একটা জুয়াখেলার মতো। তার মুখে অক্সিজেনের ছোট মাস্ক থাকার কারণে এবং বাতাসের শব্দে ভালো করে কথা শোনা যাচ্ছে না বলে প্রায় চিৎকার করে কথা বলতে হল।