কুশান বলল, আমি দেখেছি।
কোথায় দেখেছ?
মাইক্রোস্কোপে। কোষের ভেতরে এভাবে ব্যাক্টেরিয়া কিলবিল করে বের হতে থাকে।
শব্দ করে হাসতে গিয়ে রিরা থেমে গেল, বলল, ঠিকই বলেছ। এই প্রাণীগুলো ব্যাক্টেরিয়ার মতো। কী ভয়ানক!
কুশান বলল, চলো মহাকাশযানের ভেতরে যাই।
হ্যাঁ, বাইরে শীতে আর দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না।
গ্রহটি কতক্ষণ অন্ধকার থাকবে সে সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। দুজনে কোনো ঝুঁকি নিল না। তারা পালাক্রমে পাহারা দিল, যদি প্রাণীগুলো আবার ফিরে আসে, তা হলে আবার ফ্লেয়ারটি জ্বালাতে হবে। অন্ধকার গ্রহটিতে দুজনে অপেক্ষা করতে থাকে আলোর জন্য।
০৯. ক্যাপ্টেনের ঘরে টেবিলের দুইপাশে
ক্যাপ্টেনের ঘরে টেবিলের দুইপাশে দুজনে বসে চুপচাপ খাচ্ছে। দুজনের চেহারাতেই এক ধরনের ক্লান্তির ছাপ। গ্রহটিতে তিন দিন পরে আলো ফিরে এসেছে। এই তিন দিন তারা বিশ্রাম নেবার ঝুঁকি নেয় নি। এই গ্রহের প্রাণীগুলো বুদ্ধিহীন নির্বোধ হতে পারে, কিন্তু তাদের সংখ্যা বিশাল। এই বিশাল সংখ্যার সাথে বুদ্ধি বা কৌশল কিংবা কোনোকিছুতেই কেউ পেরে উঠবে না। ফ্লেয়ার জ্বালিয়ে প্রথমবার প্রাণীগুলোকে তারা ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে। ফ্লেয়ারের আলো নিভে যাবার পর প্রাণীগুলো আবার ফিরে আসতে পারত সৌভাগ্যক্রমে ফিরে আসে নি।
রিরা এবং কুশানের খুব সৌভাগ্য যে, প্রাণীগুলো আলো সহ্য করতে পারে না এবং ফ্লেয়ারের মতো একটা তুচ্ছ জিনিস দিয়ে ভয় দেখিয়ে সেগুলোকে তাড়িয়ে দেওয়া গেছে। কিন্তু রিরা এবং কুশান খুব ভালো করে জানে যে, যদি তাদের অনির্দিষ্ট সময় এখানে থাকতে হয়, তা হলে আগে হোক পরে হোক তাদের ফ্লেয়ার ফুরিয়ে যাবে এবং কোনো এক অন্ধকার মুহূর্তে এই লক্ষ লক্ষ প্রাণী এসে তাদেরকে শেষ করে দেবে। অসংখ্য ভাইরাস যেভাবে জীবকোষকে কুরে কুরে খেয়ে ফেলে, এই প্রাণীগুলোও তাদেরকে সেভাবে খেয়ে ফেলবে। পুরো বিষয়টি চিন্তা করে রিরা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমরা একটা বিপদের মাঝে আছি।
কুশান সম্মতিসূচকভাবে মাথা নাড়ল। রিরা চোখ বড় বড় করে বলল, কুশান, তোমাকে আমি সঠিকভাবে মানুষ হিসেবে ট্রেনিং দিতে পারি নি।
কেন? কী হয়েছে?
আমি যখন বলব আমরা একটা বিপদের মাঝে আছি, তখন তুমি হেসে পুরো ব্যাপারটি উড়িয়ে দিয়ে বলবে, কে বলেছে বিপদ? কোনো বিপদ নেই!
বিপদ থাকলেও বলব বিপদ নেই?
হ্যাঁ। মানুষ এভাবে একজন আরেকজনকে সাহস দেয়।
কুশান একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, ঠিক আছে রিরা, আমি জেনে রাখলাম। পবেব বার আমি বলব কোনো বিপদ নেই। আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে আমাদের এরকম অনেক সুযোগ আসবে!
রিরা উষ্ণ স্নায়ু-সতেজকারী পানীয়টাতে একটা চুমুক দিয়ে বলল, আমরা কী করব সেটা খুব ভালো করে ঠিক করে নিতে হবে।
কুশান মাথা নাড়ল, বলল, হ্যা।
এই আজব গ্রহটার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। হঠাৎ করে এটা পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে যায় কেমন করে?
উপগ্রহের চৌম্বকক্ষেত্রের একটা বিচ্যুতি হয় বলে মনে হচ্ছে।
দুদিন পরে পরেই যদি এরকম বিচ্যুতি ঘটতে থাকে, তা হলে আমাদের কী হবে?
কুশান কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে দুই হাতে ধরে এক টুকরো কৃত্রিম প্রোটিন চিবুতে থাকে।
যখন গ্রহটা আলোকিত থাকে, তখন প্রাণীগুলো কোথায় থাকে বলে মনে হয়?
মাটির নিচে কোনো অন্ধকার গুহা নিশ্চয়ই আছে।
কতগুলো প্রাণী দেখেছ? এতগুলো প্রাণী থাকার জন্য বিশাল বড় এলাকা দরকার।
হ্যাঁ। কুশান মাথা নাড়ল, বলল, আমরা তো আসলে গ্রহটা সম্পর্কে কিছুই জানি না।
রিরা নিঃশব্দে শুকনো একটা রুটির টুকরো চিবুতে চিবুতে বলল, আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। গ্রহটা কখন আবার অন্ধকার হয়ে যাবে আমরা জানি না।
কুশান কোনো কথা বলল না।
রিরা বলল, এই গ্রহের অধিবাসীরা কীভাবে মারা গিয়েছিল, আমি এখন খানিকটা অনুমান করতে পারি।
কীভাবে?
নিশ্চয়ই আলোর ব্যবস্থা করতে করতে সমস্ত জ্বালানি শেষ করে ফেলেছিল। আমরা সতর্ক না থাকলে আমাদেরও সেই অবস্থা হবে।
তুমি কীভাবে সতর্ক থাকবে রিরা?
খুব যত্ন করে জ্বালানি খরচ করতে হবে। আলো জ্বালিয়ে রাখার নতুন কোনো বুদ্ধি বের করতে হবে।
কুশান আস্তে আস্তে বলল, আগে হোক পরে হোক আমাদের জ্বালানি শেষ হয়ে যাবে রিরা।
রিরা একটা নিশ্বাস ফেলে অন্যমনস্কভাবে নিজের হাতের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, যেভাবেই হোক আমাদের কমিউনিকেশান্স মডিউলটি ঠিক করতে হবে। আমাদের বাইরের মহাকাশে খবর পাঠাতেই হবে। কারো না কারো এসে আমাদের উদ্ধার করতেই হবে।
কুশান কোনো কথা না বলে এক ধরনের বিচিত্র দৃষ্টিতে রিরার দিকে তাকিয়ে রইল। রিরা জিজ্ঞেস করল, কী হল, তুমি এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছ কেন?
কুশান তার চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, না। এমনিই।
ভালো করে বিশ্রাম নিয়ে রিরা আর কুশান কমিউনিকেশান্স মডিউলটি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মূল প্রসেসরের কাছ থেকে পাওয়া যোগাযোগ মডিউলের ম্যানুয়েলগুলো দেখে রিরা। আর কুশান মোটামুটি হতাশ হয়ে পড়ে। অত্যন্ত জটিল সার্কিট, এই বিষয়ে কয়েক বছরের আনুষ্ঠানিক পড়াশোনা না থাকলে এগুলো নিয়ে কাজ করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। দুজনে মিলে অনেক কষ্ট করে সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত একটা বিসিতারকে কোনোমতে আবার চালু করে নেয়। সুইচ অন করেই অবশ্য তারা হতাশ হয়ে গেল, রিসিভারটি একটু পরে পরেই বিপ করে একটি শব্দ করছে। যার অর্থ সার্কিটে সমস্যা থাকার কারণে এখানে কোনো এক ধরনের ফিডব্যাক হচ্ছে। রিরা কিছুক্ষণ বিষদৃষ্টিতে রিসিভারটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমাদের এত ঘণ্টার পরিশ্রম একেবারে বৃথা গিয়েছে!