কী হয়েছে?
এই মহাকাশযানে ফেয়ার আছে। বাইরে গিয়ে উপরে ছুড়ে দিয়ে জ্বালিয়ে দিলে পুরো এলাকাটা আলোকিত হয়ে যাবে। তীব্র উজ্জ্বল চোখ ধাঁধানো আলো।
চমৎকার! কোথায় আছে জান?
রিরা মাথা নাড়ল, বলল, জানি। তুমি দাঁড়াও আমি নিয়ে আসছি।
কিছুক্ষণের মাঝেই রিরা দুটো ফ্লেয়ার হাতে নিয়ে এল। দুটোর পেছনেই ছোট্ট একটি করে রকেট লাগানো রয়েছে। খোলা জায়গায় নিয়ে সুইচটা টিপে ছেড়ে দিলেই স্বয়ংক্রিয় কন্ট্রোল এটা চালু করে কয়েক শ মিটার উপরে নিয়ে যাবে। সেখানে তীব্র উজ্জ্বল আলোয় আশপাশে কয়েক কিলোমিটার আলোকিত করে খুব ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসবে। কশান চিন্তিত মুখে ফ্লেয়ার দুটোর দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, এটা নিয়ে বাইরে যেতে হবে।
রিরা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ।
এই মহাকাশযানটিকে এই অজানা গ্রহে অবতরণ করানোর পর এখন পর্যন্ত তারা বাইরে যায় নি। কোনো একটা কিছু প্রথমবার করার সময় একটু অনিশ্চয়তা থাকে। এখানে সেই অনিশ্চয়তা অনেকগুণ বেশি। এই মুহূর্তে বাইরে হাজার হাজার হিংস্র প্রাণী মহাকাশযানটাকে কেটে ঢোকার চেষ্টা করছে—পরিস্থিতিটা শুধু অনিশ্চিত নয়, অত্যন্ত বিপজ্জনক। মহাকাশযান ঘিরে কর্কশ শব্দ আরো অনেক বেড়ে গেছে। মনে হচ্ছে কোনো এক জায়গা ভেদ করে সত্যি সত্যি প্রাণীগুলো যে কোনো মুহূর্তে ঢুকে যাবে। রিরা একটা ফ্লেয়ার হাতে নিয়ে বলল, আমি বাইরে নিয়ে যাচ্ছি। তুমি আমাকে কাভার দাও।
কুশান মাথা নেড়ে বলল, নানা রিরা। তুমি যাবে না। তুমি ভেতরে থেকে একটা সার্চলাইট নিয়ে আমাকে কাভার দাও। আমি যাচ্ছি।
রিরা একটু অবাক হয়ে কুশানের দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু কুশান, তুমি একজন নীলমান। তুমি মানুষের মতো বিচ্ছিন্ন সত্তা নও তুমি সমন্বিত। আমি যা বলেছি তুমি সব সময় সেটা শুনেছ।
কুশানের মুখে হঠাৎ একটা মৃদু হাসি ফুটে ওঠে। সে রিরার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি তোমার সাথে থাকতে থাকতে মনে হয় মানুষের মতো হয়ে যাচ্ছি।
এটা কি ভালো না খারাপ?
এখনো বুঝতে পারছি না।
রিরা বলল, এখন সময় নষ্ট করে লাভ নেই তুমি নীলমানব, আমাদের প্রযুক্তির সাথে অভ্যস্ত নও, আমাকেই করতে দাও।
একটা সুইচ টিপে দেওয়ার জন্য কি আর প্রযুক্তিতে অভ্যস্ত হতে হয়?
ঠিক আছে, তা হলে দুজনেই যাই। হাতে অস্ত্র থাকবে, সাথে দু শ লুমেনের সার্চলাইট।
সত্যি যেতে চাও? কুশান দ্বিধান্বিতভাবে বলল, তুমি যদি ভেতরে থেকে কাভার দাও, আমি পারব।
ঝুঁকি নিয়ে লাভ নেই। দুজন একসাথে গেলে বিপদের ঝুঁকি কম।
মহাকাশযানের দেয়ালে প্রচও কর্কশ শব্দটা মনে হল হঠাৎ বেড়ে গেছে, রিরার মনে হতে থাকে হঠাৎ বুঝি কোনো একটা দেয়াল ভেঙে হুঁড়মুড় করে বীভৎস কিছু প্রাণী ভেতরে। ঢুকে যাবে। রিরা আর কুশান দ্রুত প্রস্তুত হয়ে নিল। পিঠে অক্সিজেন সিলিন্ডার, নিশ্বাস নেবার জন্য মুখে একটা মাস্ক, মাথায় শক্ত হেলমেটে তীব্র সার্চলাইট, হাতে অস্ত্র। মহাকাশযানের দরজার সামনে গিয়ে বড় হ্যান্ডেলটা নিচের দিকে চাপ দিতেই ঘটাং করে ভেতরের কুঠুরিটা খুলে গেল। সেখানে ঢুকে ভেতরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে বাইরের বাতাসের সাথে সমতা আনতে শুরু করল। রিরা কিংবা কুশীন কেউই বুঝতে পারে নি গ্রহটা অন্ধকার হয়ে যাবার পর হঠাৎ করে এত দ্রুত এরকম ভয়ংকর ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। এখন কিছু করার নেই, কনকনে শীতে দুজন অপেক্ষা করতে থাকে, কিছুক্ষণের মাঝেই মূল দরজাটা খোলার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। রিরা গেলি হান্ডেলটা ঘুরিয়ে বড় লিভারে হাত রেখে বলল, কুশান, আমি দরজা খুলছি।
খোল। আমি আলো আর অস্ত্র দুটি নিয়েই প্রস্তুত।
রিরা পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে হঠাৎ দরজাটা খুলে দিতেই তীক্ষ্ণ আর্তনাদ করতে করতে কিছু প্রাণী চারদিকে ছুটে সরে যেতে থাকে। প্রাণীগুলোর আকার বোঝা যায় না–একইসাথে সরীসৃপ কিংবা কীটের মতো মনে হয়। সমস্ত দেহ পিচ্ছিল এক ধরনের পদার্থ দিয়ে ঢাকা, আলো পড়তেই মুহূর্তের মাঝে সেখানে বড় বড় বীভৎস ফোসকার মতো বের হতে শুরু করেছে। প্রাণীগুলো ধারালো দাঁত বের করে যন্ত্রণায় চিৎকার করতে করতে সরে যাচ্ছে—মাথার কাছে ছোট ছোট কুতকুতে হলুদ চোখে এক ধরনের বোবা আতঙ্ক।
রিরা আর কুশান হাতে অস্ত্র নিয়ে সতর্কভাবে আরো কয়েক পা অগ্রসর হয়, বাইরে কনকনে ঠাণ্ডা এবং বাতাসে এক ধরনের ঝালো গন্ধ। প্রাণীগুলো ছুটে দূরে সরে গিয়ে। তাদের জন্য অপেক্ষা করছে অন্ধকারে হঠাৎ হঠাৎ ধারালো দাঁত চকচক করে উঠছে। কুশান হাতে অস্ত্র নিয়ে সতর্কভাবে চারদিকে তাকাতে তাকাতে ফিসফিস করে বলল, রিরা। তুমি ফ্লেয়ারটা ছাড়। দেরি করো না।
রিরা বলল, হ্যাঁ, ছাড়ছি।
সে ভেতরকার টাইমারটাকে পাঁচচ সেকেন্ডের জন্য সেট করে ফ্লেয়ারটা একটা পাথরের উপর রেখে পিছিয়ে এল। মনে মনে পচ পর্যন্ত গোনার আগেই ফেয়ারের রকেটটা তীব্র শব্দ করে উপরে উঠে গেল, প্রায় সাথে সাথেই পুরো এলাকাটা তীব্র আলোতে ঝলসে ওঠে। আশপাশে কয়েক কিলোমিটার এলাকা উজ্জ্বল সূর্যালোকে আলোকিত মধ্যাহ্নের মতো আলোকিত হয়ে যায়।
মহাকাশযানকে ঘিরে থাকা হাজার হাজার বীভৎস প্রাণীগুলোর ভেতর হঠাৎ করে একটা ভয়ংকর বিপর্যয় ঘটে যায়। তীব্র স্বরে চিৎকার করতে করতে সেগুলো সরে যেতে থাকে–একটি প্রাণী অন্যটির উপর দিয়ে হুঁটোপুটি করে আতঙ্ক এবং যন্ত্রণায় আর্তনাদ করতে করতে সেগুলো প্রাণভয়ে ছুটে যেতে থাকে। কিছুক্ষণের মাঝে তারা সবিস্ময়ে দেখতে পায়–আক্ষরিক অর্থে হাজার হাজার প্রাণী গ্রহটির পাথরের উপরে লাফিয়ে লাফিয়ে সরে যাচ্ছে। যতদূর চোখ যায় ততদূর পর্যন্ত কুৎসিত প্রাণী কিলবিল করছে। রিরা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি আমার জীবনে কখনো একসাথে এতগুলো প্রাণী দেখি নি।