কুশান শব্দ করে হাসল। বলল, আমরা কথা না বলেও তথ্য আদান-প্রদান করতে পারি। একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে শুধু চোখের ভাষায় অনেক কিছু বলে দিতে পারি। তা ছাড়া
তা ছাড়া কী?
আমাদের মূল পরিকল্পনাটা করেছি তোমাদের চোখের সামনে, তোমরা বুঝতে পার নি।
কীভাবে?
মনে আছে মেঝেতে ছক কেট শুকনো রুটির টুকরো দিয়ে আমরা খেলতাম?
হ্যাঁ। মনে আছে।
সেই খেলাটা আসলে শুধু খেলা ছিল না। খেলাটার আড়ালে আমরা পরিকল্পনা করেছি।
তোমরা চিন্তা-ভাবনা করে ঠিক করেছিলে কে কবজি কেটে আত্মহত্যা করবে?
হ্যাঁ, আমরা নিজিতকে বেছে নিয়েছিলাম। সে ছিল আমাদের মাঝে দুর্বল। যুদ্ধে সে একটু আহত হয়েছিল।
সে একবারও আপত্তি করে নি?
কুশান মাথা নাড়ল, বলল, আসলে আমরা সবাই মিলে একটা প্রাণীসত্তা। আমরা আলাদা না—আমরা কখনো আপত্তি করি না। আপত্তি করা যায়, সেটা আমরা জানিও না।
কী আশ্চর্য! মানুষ কখনোই এভাবে চিন্তা করতে পারবে না।
রিরার কথার উত্তরে কুশান কোনো কথা না বলে হঠাৎ উঠে দাঁড়াল, অন্ধকারে আবছাভাবে রিরা দেখতে পায়—সে দ্রুতপায়ে কোয়ার্টজের জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। রিরা ভয় পাওয়া গলায় বলল, কী হয়েছে কুশান?
আসছে!
কে আসছে?
আমার মনে হয় এই গ্রহের প্রাণী!
রিরা কোয়ার্টজের জানালার কাছে ছুটে গিয়ে বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকারের দিকে তাকাল। গাঢ় অন্ধকারে কিছুই সে দেখতে পায় না। অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে কুশানকে ধরে একটা ঝাকুনি দিয়ে বলল, তুমি দেখতে পাচ্ছি?
হ্যাঁ।
কোথায় এখন, কী করছে? দেখতে কেমন? কুশান চাপা গলায় বলল, আমি ঠিক বোঝাতে পারব না, তুমি শব্দ শুনতে পাচ্ছ না?
রিরা কান পেতে শুনল, মনে হল ঝড়ের মতো একটা শব্দ হচ্ছে, দূর থেকে শোনা অনেক মানুষের কোলাহলের মতো। খুব ধীরে ধীরে শব্দটা বাড়ছে, তাদের দিকে এগিয়ে আসছে এই গ্রহের প্রাণী। বুদ্ধিহীন, ভয়ংকর এবং নৃশংস প্রাণী।
০৮. একটা পাথর এসে
প্রথমে মনে হল কোনো একটা পাথর এসে মহাকাশযানকে আঘাত করেছে, তারপর মনে হল আরো একটা, তারপর অনেকগুলো। শিলাবৃষ্টির মতো হঠাৎ শব্দ হতে শুরু হয়ে গেল। মনে হল প্রচণ্ড ঝড়ে মহাকাশযানটি থরথর করে কাপতে শুরু করেছে। অন্ধকারে রিরা আবছা আবছাভাবে দেখতে পেল, কুশান কোয়ার্টজের জানালা থেকে ছিটকে পিছনে সরে এসেছে। রিরার হাত ধরে চাপা গলায় বলল, পালাও।
কেন? কী হয়েছে?
ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে।
ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে? রিরা ভয় পাওয়া গলায় বলল, কেমন করে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে?
জানি না। ভয়ংকর ধারালো দাঁত মনে হয় শুনতে পাচ্ছ না? রিরা শুনতে পেল, মহাকাশযানটিতে একটা কর্কশ শব্দ। মনে হয় ধারালো ফাইল দিয়ে কেউ যেন কাটছে। চারদিক থেকে কর্কশ শব্দ আসছে, মনে হয় কেটে কেটে টুকরো করে ফেলছে। রিরা বলল, আলো জ্বালাও আমি একটু দেখব।
দেখার মতো কিছু নেই রিরা, বীভৎস।
আমি তবু দেখতে চাই।
কুশান দেয়ালের কাছে গিয়ে আলো জ্বালানোর নিরাপত্তা সুইচে গোপন সংখ্যা প্রবেশ করাতেই অবজারভেশান টাওয়ারে উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠল—রিরার চোখ ধাধিয়ে যায় মুহূর্তের জন্য। কিছু স্পষ্ট দেখতে পায় না সে, শুধু কোয়ার্টজের জানালায় ধারালো দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে থাকা বীভৎস একটা প্রাণী মুহর্তের জন্য দেখতে পেল, কিন্তু সাথে সাথে বিকট আর্তচিৎকারে পুরো এলাকাটা প্রকম্পিত হতে থাকে।
আশ্চর্য! কুশান কঁপা গলায় বলল, কী আশ্চর্য!
রিরা দুই হাতে চোখ ঢেকে বলল, কী হয়েছে?
প্রাণীগুলো আলো সহ্য করতে পারে না। সব পালিয়ে যাচ্ছে।
রিরা সাবধানে চোখ খুলে তাকাল, সত্যি সত্যি কোয়ার্টজের জানালায় ধারালো দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে থাকা প্রাণীগুলো নেই…। বাইরে অসংখ্য প্রাণীর আর্তচিৎকার, ছোটাছুটি শোনা যাচ্ছে, একসাথে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করছে সবগুলো প্রাণী।
আলো জ্বালিয়ে দিতে হবে আমাদের। মহাকাশযানের সব আলো জ্বালিয়ে দিতে হবে এক্ষুনি।
হ্যাঁ, চল তাড়াতাড়ি।
মহাকাশযানের ভেতরে আলো জ্বালাতে গিয়ে রিরা আর কুশান আবিষ্কার করল, জ্বালানি বাচানোর জন্য তারা মহাকাশযানের বেশিরভাগ অংশের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে রেখেছে। নতুন করে সংযোগ দিয়ে আলো জ্বালাতে জ্বালাতে অনেক সময় লেগে যাবে। এই সময়ের ভেতরে প্রাণীগুলো ধারালো দাঁত দিয়ে মহাকাশযানের দেয়াল কেটে ভেতরে ঢুকে যাবে। মহাকাশযানের যেখানে যেখানে আলো আছে—বাইরে আলো ছড়িয়ে পড়েছে, সেখানে প্রাণীগুলো নেই, কিন্তু অন্ধকার অংশগুলোতে ফাইল দিয়ে ঘষে কাটার মতো শব্দ করে প্রাণীগুলো ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছে। প্রাণীগুলো কত বড়, দেখতে কী রকম রিরা ভালো করে জানে না কিন্তু শব্দ শুনে বোঝা যায় অসংখ্য প্রাণী একসাথে এসেছে, কোথাও যদি কেটে ঢুকে যেতে পারে তা হলে রক্ষা পাবার উপায় নেই। মহাকাশযানের চারদিকে এক ধরনের অশুভ কর্কশ শব্দ। রিরা হঠাৎ ভয়াবহ এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করে।
কুশানের মুখে উত্তেজনার কোনো চিহ্ন নেই। সে একটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র রিরার হাতে দিয়ে বলল, এটা তোমার হাতে রাখ। ভেতরে ঢুকে গেলে কাজে লাগতে পারে।
আমাদের দরকার সার্চলাইটের মতো আলো। শক্তিশালী ফ্ল্যাশলাইট।
হ্যাঁ। কোথায় আছে জান?
স্টোররুমে। ইমার্জেন্সি কিটের ভেতরেও থাকতে পারে।
তুমি দাঁড়াও আমি নিয়ে আসি।
রিরার হঠাৎ একটা জিনিস মনে হল, বলল, কুশান! দাঁড়াও।