কুশান কোনো কথা না বলে একটু বিস্ময়ের ভঙ্গি করে রিরার দিকে তাকিয়ে রইল, তাকে দেখে মনে হতে থাকে হঠাৎ করে আলোকোজ্জ্বল একটা গ্রহ অন্ধকার হয়ে যাওয়া বুঝি খুব স্বাভাবিক ব্যাপার।
কিছুক্ষণের মাঝে চারদিক নিকষ কালো অন্ধকারে ঢেকে গেল। উজ্জ্বল আলোতে অভ্যস্ত চোখ হঠাৎ করে এই গাঢ় অন্ধকারে কেমন যেন এক ধরনের নির্ভরতা খুঁজে পায়। রিরা খানিকটা বিস্ময় নিয়ে বলল, এই অন্ধকারটা কেমন অদ্ভুত দেখেছ? কোনো কিছু দেখতে না পাওয়ার মাঝে এক ধবনের আরাম আছে।
কুশান নিচু গলায় বলল, তুমি সত্যি কিছু দেখতে পাচ্ছ না?
রিরা অবাক হয়ে বলল, তুমি কী বলতে চাইছ? তুমি দেখতে পাচ্ছ?
হ্যাঁ। আমি দেখতে পাচ্ছি।
হঠাৎ করে রিরার মনে পড়ল কুশানের চোখ ইনফ্রারেড থেকে আলট্রাভায়োলেট পর্যন্ত সংবেদী। রিরার চোখে যখন সবকিছু অন্ধকার, কুশান তখনো দেখতে পারে কিন্তু তবুও তার কাছে ব্যাপারটা অসম্ভব মনে হতে থাকে। সে অবাক হয়ে বলল, তুমি সত্যি দেখতে পাচ্ছ?
হ্যাঁ রিরা, আমি সবকিছু দেখতে পাচ্ছি।
তুমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছ?
হ্যাঁ, আমি সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। একটু নীলাভ রঙ, কিন্তু স্পষ্ট।
রিরা হঠাৎ ছেলেমানুষের মতো গলায় বলল, আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি না।
কুশান শব্দ করে হেসে বলল, তোমাকে আমার সব কথা বিশ্বাস করতে হবে কে বলেছে?
আমাকে তুমি ছুঁতে পারবে?
কেন পারব না?
রিরা একটু সরে বসে বলল, ছোঁও দেখি।
রিরা হঠাৎ করে অনুভব করে একটা হাত খুব আলতোভাবে তাকে স্পর্শ করল–অনেকটা আদর করার মতো তার গাল স্পর্শ করে হাতটি তার চিবুকের কাছে এসে থেমে যায়। কুশান বলল, এটা তোমার চিবুক।
রিরা অনুভব করে হাতটি সরে গিয়ে খুব কোমলভাবে তার চুল স্পর্শ করে বলল, এই যে তোমার চুল। রিরা হঠাৎ অনুভব করল কুশানের দুটি হাত খুব ধীরে ধীরে তার দুই গালের কাছে এসে তার মুখটি উপরে তুলেছে খুব কাছে থেকে সে হঠাৎ কুশানের নিশ্বাস শুনতে পেল। রিরা হঠাৎ কেমন যেন অস্বস্তি অনুভব করে, সে ইতস্তত করে বলল, কুশান, তুমি কী করছ?
তোমাকে দেখছি।
আমাকে তুমি আগে দেখ নি?
অবশ্যই দেখেছি, কিন্তু এখন—
এখন কী?
এখন সবকিছুতে একটু নীলচে আভা। আর—
আর কী?
নীলচে আভাতে তোমাকেও নীল দেখাচ্ছে। হঠাৎ করে তোমাকে একটা নীলমানবীর মতো লাগছে। তোমাকে এত সুন্দর দেখাচ্ছে যে, আমি চোখ ফেরাতে পারছি না রিরা।
রিরা হঠাৎ একটু লজ্জা পেয়ে যায়, সে সাবধানে কুশানের হাত দুটি সরিয়ে হালকা গলায় বলল, তার অর্থ কী বুঝতে পারছ?
কী?
সাধারণ আলোতে আমার চেহারায় কোনো সৌন্দর্য নেই। আমার সৌন্দর্য আসে শুধুমাত্র নীল আলোতে যখন আমাকে নীলমানবীর মতো দেখায়!
আমি সেটা বলতে চাই নি রিরা।
তুমি তা হলে কী বলতে চাইছ?
কুশান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি ঠিক জানি না রিরা। আমি খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারি না। হঠাৎ করে নীলাভ আলোতে তোমাকে দেখে আমার পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ে গেল।
পুরোনো দিনের কথা?
হ্যাঁ, আমার শৈশবের কথা, আমার পরিরারের কথা। যুদ্ধে নাম লেখানোর পর থেকে বহুকাল তাদের কারো সাথে যোগাযোগ নেই। তারা কে কোথায় আছে, কেমন আছে কিছু জানি না।
রিরা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি যখন একাডেমিতে পড়ছি, তখন তোমাদের ওপর আমাদের একটা কোর্স করতে হত। সেখানে আমাদের শেখানো হয়েছিল—তোমরা। অত্যন্ত দুর্ধর্ষ এবং একরোখা।
রিরার কথা শুনে কুশানের কী প্রতিক্রিয়া হল অন্ধকারে ঠিক দেখা গেল না। রিরা বলল, আলো জ্বেলে দিই।
কুশান বলল, আর একটু পর, ছোট ওয়েভলেংথে দেখতে একেবারে অন্যরকম লাগছে।
তোমার অন্যরকম লাগছে। আমি যে কিছু দেখছি না? ঘুটঘুটে অন্ধকার।
তোমরা মানুষেরা নাকি অসম্ভব কল্পনা করতে পার। তুমি কল্পনা করে দেখ!
আমাদের মানুষদের সম্পর্কে তোমরা আর কী কী জান?
কুশান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমাদের জন্ম থেকে শেখানো হয়েছে মানুষ অামাদের সবচেয়ে বড় শত্রু। শেখানো হয়েছে মানুষ আমাদেরকে ধ্বংস করে ফেলবে বলে ঠিক করেছে। মানুষের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য আমাদের যুদ্ধ করতে হবে।
কী আশ্চর্য!
হ্যাঁ, মানুষের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য আমরা নিজেদের মাঝে বিবর্তন এনেছি–আমরা নিজেদের শরীরকে উন্নত করেছি। আমরা এখন অন্ধকারে দেখতে পাই। আমাদের ফুসফুসের আকার বড়, সেখানে অক্সিজেন জমা রাখতে পারি।
রিরা বাধা দিয়ে বলল, এখন বুঝতে পেরেছি, যখন নিথিলিয়াম গ্যাস দিয়ে তোমাদের অচেতন করার চেষ্টা করা হয়েছিল তখন তোমরা কেন অচেতন হও নি!
হ্যাঁ। আমাদের পরিকল্পনায় তোমরা পা দিয়েছিলে।
ক্যাপ্টেন বৰ্কেন হলে ঠিক অনুমান করেছিলেন।
কুশান কোনো কথা না বলে চুপ করে রইল। ঘুটঘুটে অন্ধকারে রিরার চোখ খানিকটা অভ্যস্ত হয়ে এসেছে। এখন খুব হালকাভাবে সে কুশানের অবয়ব দেখতে পায়, বাইরে গ্রহের দিগন্তটুকুও হালকাভাবে চোখে পড়তে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে আকাশের এক-দুটি নক্ষত্রও মিটমিট করে দেখতে শুরু করেছে। চোখ অভ্যস্ত হয়ে যাবার পর অন্ধকারটুকু বেশ লাগছে, তবে সে দেখতে পাচ্ছে না কিন্তু কুশান তাকে স্পষ্ট দেখছে—এই চিন্তাটুকু মাঝে। মাঝেই তাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে।
রিরা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি একটা জিনিস কখনো বুঝতে পারি না। তুমি বলছ আমরা তোমাদের পরিকল্পনায় পা দিয়েছিলাম। কিন্তু তোমরা কখন পরিকল্পনা। করেছ? আমাদের মূল প্রসেসর সব সময় তোমাদের চোখে চোখে রেখেছে—তোমাদের প্রত্যেকটি কথা শুনেছে, প্রত্যেকটি অঙ্গভঙ্গি লক্ষ করেছে!