ক্যাপ্টেন বৰ্কেন হাসি গোপন করে বললেন, অবিশ্যি তুমি ভয় পাচ্ছ না রিরা। আমি জানি তুমি সাহসী মেয়ে। সাহসী না হলে কেউ মহাকাশযানের অভিযাত্রী হয় না।
দুজন বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। মহাকাশযানটি প্রায় নিঃশব্দ, খুব চেষ্টা করলে তার শক্তিশালী ইঞ্জিনের মৃদু গুঞ্জন শোনা যায়। রিরা একটু ইতস্তত করে বলল, মহামান্য ক্যাপ্টেন, আপনাকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করতে পারি?
হ্যাঁ, জিজ্ঞেস কর।
আমাদের এই মহাকাশযানে করে আমরা নাকি একটা বিপজ্জনক কার্গো নিয়ে যাচ্ছি?
ক্যাপ্টেন বৰ্কেন একটু অবাক হয়ে বললেন, তুমি কোন কার্গোর কথা বলছ রিরা?
এই মহাকাশযানে করে নাকি একটা নীলমানবের দল নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?
হ্যাঁ। আমাদের মহাকাশযানে সতের জন নীলমান আছে। ক্লড উপগ্রহের যুদ্ধে এরা ধরা পড়েছে।
এরা নাকি অত্যন্ত ভয়ংকর?
ক্যাপ্টেন বর্কেন একটু হেসে বললেন, আমরা যে জিনিসটা জানি না সেটাকেই মনে করি ভয়ংকর। নীলমানব সম্পর্কেও সেটা সত্যি তাদেরকে ভয়ংকর ভাবার কারণ হচ্ছে আমরা তাদের সম্পর্ক খুব বেশি জানি না। কদাচিৎ আমরা তাদের ধরতে পারি, এই প্রথমবার একসাথে সতের জনকে ধরতে পেরেছি।
কিন্তু সেজন্য আমাদের নাকি ভয়ংকর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করতে হয়েছে?
ক্যাপ্টেন বর্কেন মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ, সেটা সত্যি। নীলমানব নতুন কিছু অস্ত্র তৈরি করেছে, যেগুলো খু্ব শক্তিশালী। তাদের মহাকাশযানের টেকনোলজিটাও ভিন্ন।
মহামান্য ক্যাপ্টেন, আমরা কি নীলমানবকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করি?
না, করি না। মানুষের বিবর্তন হয় স্বাভাবিকভাবে। নীলমানব নিজেদের মাঝে জোর করে বিবর্তন এনেছে। তাদের চোখ ইনফ্রারেড থেকে শুরু করে আলট্রাভায়োলেট পর্যন্ত সংবেদন করে ফেলেছে। তাদের রক্ত কপারভিত্তিক, তাই তাদের গায়ের রঙ হালকা নীল। আমি যতদূর জানি তারা ফুসফুসের আকার অনেক বড় করেছে, বাতাসে কম অক্সিজেনেও বেঁচে থাকতে পারে। শরীরের ভেতরে নাকি নতুন নতুন পরিবর্তন এনেছে।
রিরা একটু শিউরে উঠে বলল, কী সর্বনাশ!
এগুলো হচ্ছে কাঠামোগত পরিবর্তন। আমি শুনেছি এদের চিন্তার জগৎটাও অনেক ভিন্ন। মানুষের মতো এরা বিচ্ছিন্ন না, এদের পুরো দলটি একসাথে কাজ করে।
সেটা কীভাবে সম্ভব?
আমরা সেটা এখনো জানি না, বোঝার চেষ্টা করছি। সতের জনের এই দলটাকে মূল বিজ্ঞান একাডেমিতে পৌঁছে দিতে পারলে অনেক কিছু জানা যাবে। ক্যাপ্টেন বৰ্কেন একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, আমি সিকিউরিটি ডিভিশনকে বলেছিলাম, পুরো দলটিকে ঘুম পাড়িয়ে শীতল ঘরে নিয়ে যেতে। তা হলে আমাদের ঝামেলা খুব কম হত, কিন্তু বিজ্ঞান একাডেমি রাজি হয় নি।
কেন রাজি হয় নি মহামান্য ক্যাপ্টেন?
এই মহাকাশযানে করে যখন নেওয়া হবে.তখন তারা কী করে বিজ্ঞান একাডেমি সেটা দেখতে চায়। তারা কীভাবে কথা বলে, কীভাবে সময় কাটায় ব্যাপারটা নিয়ে গবেষণা করবে।
রিরা একটু অবাক হয়ে বলল, এর মাঝে গবেষণা করার কী আছে মহামান্য ক্যাপ্টেন?
ক্যাপ্টেন বর্কে একটু হেসে বললেন, নীলমানরা অসম্ভব সাহসী, অসম্ভব একরোখা, প্রায় খ্যাপা ধরনের প্রাণী। তারা মহাকাশযান থেকে বের হয়ে যাবার চেষ্টা করবেই কীভাবে চেষ্টা করবে সেটাই দেখতে চায়।
রিরার মুখে আতঙ্কের একটা ছাপ পড়ল, বলল, সর্বনাশ! যদি সত্যি বের হয়ে যায়?
ক্যাপ্টেন বৰ্কেন হাসলেন, বললেন, এত সোজা নয়। ওদের পুরো ঘরটা চব্বিশ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। আমি ছয় জন নিরাপত্তা প্রহরীকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে–অস্বাভাবিক কিছু ঘটলে সাথে সাথে গুলি করার অনুমতি আছে।
রিরা সাবধানে একটা নিশ্বাস ফেলল। খানিকক্ষণ দেয়ালের বিশাল মনিটরটির দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে ক্যাপ্টেন বর্কেনকে জিজ্ঞেস করল, মহামান্য ক্যাপ্টেন, নীলমানবেরা কী ভাষায় কথা বলে?
তাদের নিজেদের ভাষা রয়েছে। একসময় তো নীলমানবেরা মানুষই ছিল, তাই আমাদের ভাষার সাথে মিল আছে। কথা শুনলে মোটামুটি বোঝা যায়।
ওরা এখানে কী নিয়ে কথা বলছে?
প্রথম কয়েকদিন লক্ষ করেছিলাম একেবারে দৈনন্দিন কথাবার্তা। মেঝেতে দাগ কেটে কী একটা খেলা খেলছে, অনেকটা দাবার মতো। বসে বসে সেটা খেলে।
কোনোরকম দুশ্চিন্তা নেই?
থাকলেও কথায় বার্তায় সেটা বোঝার কোনো উপায় নেই। খুব চাপা স্বভাবের।
ওদের মাঝে কি মেয়ে আছে?
আছে। ছেলেমেয়ের ব্যাপারটা আমাদের মতোই, সব কাজে সমান সমান। এখানে সতের জনের মাঝে আট জনই মেয়ে। দলটার যে নেতৃত্ব নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে সেও একজন মেয়ে। কমবয়সী একরোখা ধরনের।
মহামান্য ক্যাপ্টেন, আমি কি তাদের দেখতে পারি?
যখন তোমার ডিউটি দেওয়া হবে, তখন তো দেখবেই। কাছে থেকে দেখবে। এখন দেখতে চাইলে এই মনিটরে দেখ।
ক্যাপ্টেন বৰ্কেন একটা সুইচ টিপে দিতেই বড় মনিটরে অবরুদ্ধ একটা ঘরের ছবি ফুটে উঠল। ঘরের ভেতর সতের জন নানাবয়সী নীলমানব ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। একজন মাথার নিচে হাত দিয়ে শুয়ে নিষ্পলক চোখে ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে, মুখে গভীর একটা বিষণ্ণতার ছাপ। গায়ের রঙ হালকা নীল, দেখে মনে হয় বুঝি কোনো একটি অশরীরী প্রাণী। দুজন মেঝেতে দাগ কাটা ছকের দু পাশে বসে খেলছে—খেলাটি প্রাচীন দাবার মতো, খুঁটি নেই বলে খাবারের জন্য দেওয়া শুকনো রুটির টুকরো কেটে কেটে খুঁটিগুলো তৈরি করেছে। খেলোয়াড় দুজন গালে হাত দিয়ে ভাবছে। তাদের ঘিরে আরো কয়েকজন। নিচু গলায় কথা বলছে। দেখে মনে হয় কীভাবে খেলতে হবে, সে বিষয়ে উপদেশ দিচ্ছে।