দৈনন্দিন জীবনের ব্যাপারটি নিশ্চিত করে তাদেরকে কমিউনিকেশন্স মডিউলটির দিকে নজর দিতে হবে। প্রথমবার দেখে মনে হয়েছে পুরো ইউনিটটি ধ্বংস হয়ে গেছে, তার ভেতর থেকে কোনোটা রক্ষা করা যাবে কি না এখনো তারা জানে না। যোগাযোগের কোনো ব্যবস্থা করতে না পারলে এই মহাজগতের কেউ জানবে না যে, তারা এই গ্রহটিতে আটকা পড়ে গেছে—কেউ তাদের উদ্ধার করতে আসবে না। এক-দুইদিনের ভেতরেই কমিউনিকেশন্স মডিউলের ম্যানুয়েল নিয়ে তারা সেগুলো নিয়ে বসবে। যেভাবেই হোক একটা শক্তিশালী ট্রান্সমিটার তৈরি করে মহাবিশ্বে খবর পাঠাতে হবে যে, তারা এখানে আটকা পড়ে আছে, তাদেরকে উদ্ধার করতে হবে।
নতুন এই গ্রহে রিরা এবং কুশান বেশ কিছুদিন থেকে আছে, এই গ্রহে বুদ্ধিহীন নৃশংস এবং ভয়ংকর এক ধরনের প্রাণী থাকার কথা তারা সে ধরনের কোনো প্রাণী এখনো দেখে নি। সত্যি কথা বলতে কী তারা এখন পর্যন্ত এই গ্রহে কোনো ধরনের প্রাণীই দেখতে পায় নি। গ্রহটির ওপর নজর রাখার জন্য তারা মহাকাশযানের একেবারে উপরে একটা পর্যবেক্ষণ টাওয়ার তৈরি করেছে, কোয়ার্টজের স্বচ্ছ জানালা দিয়ে তারা বাইরে বহুদূর দেখতে পায়, যখন তাদের কোনো কাজ না থাকে রিরা এবং কুশান এই টাওয়ারে বসে নির্জন নিষ্প্রাণ গ্রহটিকে দেখে। পুরো গ্রহটিতে সব সময় এক ধরনের ভুতুড়ে আলো, আকাশের অর্ধেকটা জুড়ে একটা বিশাল উপগ্রহ অনেকটা জীবন্ত প্রাণীর মতো তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। মহাকাশটি মোটামুটি স্থিতিশীল। হঠাৎ কখনো কখনো এক ধরনের ঝড়ো হাওয়া বইতে থাকে, বাতাসে তখন এক বিচিত্র ধরনের শব্দ হতে থাকে, মনে হয় কোনো অশরীরী ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে, রিরা তখন অত্যন্ত অস্থির অনুভব করতে থাকে কিন্তু কুশানকে কখনোই বিচলিত হতে দেখা যায় না।
যখন রিরা এবং কুশানের দৈনন্দিন জীবন প্রায় রুটিন হয়ে যাবার উপক্রম হয়ে এসেছে, তখন এই গ্রহের প্রথম বিচিত্র রূপটি তাদের চোখে পড়ল।
কমিউনিকেশন্স মডিউল কক্ষে একটা সংবেদী রিলিভারকে প্রায় অনেকখানি সারিয়ে তুলতে গিয়ে রিরা এবং কুশান প্রায় টানা আট ঘণ্টা পরিশ্রম করেছে। এখন দুজনেই ক্লান্ত। কৃত্রিম প্রোটিনের সাথে কয়েকটা শক্ত রুটি, খানিকটা স্নায়ু সতেজকারী পানীয় খেয়ে দুজনে পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে এসে বসেছে। বেশ কিছুদিন একসাথে থেকে তাদের ভেতরকার ভাষার বেশ উন্নতি হয়েছে—দুজনেই দুজনকে বেশ বুঝতে পারে, কোনো একটা কিছু বোঝানোর জন্য আজকাল প্রসেসরের সাহায্য বলতে গেলে নিতেই হয় না।
রিরা টাওয়ারে বসে বাইরের মন খারাপ করা গ্রহটির দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের না জানি আর কতদিন এই গ্রহে থাকতে হবে!
কুশান তার কথার কোনো উত্তর দিল না, তার বড় এবং খানিকটা বিচিত্র চোখে রিরার দিকে তাকিয়ে রইল। রিরা আবার বলল, এই গ্রহটি আমার নার্ভের ওপর উঠে যাচ্ছে।
কুশান জিজ্ঞেস করল, কেন?
গ্রহটিতে কোনো দিন-রাত নেই, আলো-আঁধার নেই। সব সময়েই এক ধরনের ভুতুড়ে আলো।
কুশান নিচু গলায় বলল, মহাকাশচারীদের অনেক লম্বা সময় মহাকাশযানে থাকতে হয়। তাদের দিন-রাতের অনুভূতি থাকে না।
রিরা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমার আছে। আমি মনে হয় খাঁটি মহাকাশচারী নই।
কুশান একটু হেসে বলল, না রিরা। তুমি খাঁটি মহাকাশচারী। আমাদের নীলমনিবদের মাঝে তোমার মতো মহাকাশচারী পাওয়া খুব কঠিন।
রিরা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, আমার কোন কাজটি দেখে তোমার এই ধারণা হল?
তোমার সব কাজ দেখে। তুমি যেভাবে একা এই পুরো মহাকাশযানটাকে রক্ষা করেছ, তার কোনো তুলনা নেই।
রিরা একটু হেসে বলল, বেঁচে থাকার তাগিদটা অসম্ভব শক্তিশালী তাগিদ, সেজন্য মানুষ অনেক কাজ করে।
কুশান গম্ভীর মুখে বলল, আমার জানামতে তুমি শুধু একটি ভুল করেছ।
কী ভুল করেছি?
প্রথম যখন আমাকে পেয়েছিলে, তখন সাথে সাথে তোমার আমাকে হত্যা করা উচিত ছিল।
রিরা শব্দ করে হেসে বলল, সে কী! এটা তুমি কী বলছ?
আমি ঠিকই বলছি। আমাকে হত্যা না করে তুমি নিজের ওপরে অসম্ভব বড় ঝুঁকি নিয়েছিলে।
রিরা এক ধরনের কৌতকের দৃষ্টিতে কুশানের দিকে তাকিয়ে রইল। বলল, তা হলে তুমিও আমাদের মূল প্রসেসরের মতো বিশ্বাস কর তোমাকে হত্যা করা উচিত ছিল?
কুশান গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল, বলল, তুমি আমাকে হত্যা না করায় আমি এখনো বেঁচে আছি। মানুষ কীভাবে কাজ করে, ভাবনা-চিন্তা করে সেটা বোঝার সুযোগ পেয়েছি। এটি চমৎকার অভিজ্ঞতা।
রিরা কথার পিঠে আরেকটি কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেল। তার কাছে মনে হল হঠাৎ করে গ্রহটির কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে। সে চাপা গলায় ডাকল, কুশান। আমার মনে হচ্ছে গ্রহটার কিছু একটা পরিবর্তন হচ্ছে।
কী পরিবর্তন?
ঠিক বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে গ্রহটা অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে।
অন্ধকার?
হ্যাঁ। দেখ আলোটা কেমন কমে আসছে।
রিরার সন্দেহ কিছুক্ষণের মাঝেই সত্য প্রমাণিত হল। সত্যি সত্যি হঠাৎ করে গ্রহটা অন্ধকার হতে শুরু করল। বিশাল একটা চোখের মতো যে উপগ্রহটা সব সময় এই গ্রহটার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রয়েছে, তার মাঝে একটা ছায়া পড়তে শুরু করেছে, হঠাৎ করে পুরো গ্রহটা অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। রিরা বিস্ফারিত চোখে কোয়ার্টজের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল, অবাক হয়ে বলল, কী আশ্চর্য! হঠাৎ করে গ্রহটা অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে।