নীলমানব তার নিজের বিজাতীয় ভাষায় কিছু একটা বলল, রিরা তার কিছু একটা বুঝতে পারল না। সে গলা উঁচিয়ে বলল, প্রসেসর।
বলে রিরা।
কশান কী বলেছে?
সে বলেছে তোমার গায়ের রঙ যদি পচা আঙুরের মতো না হত, তা হলে তোমাকে মোটামুটি সুন্দরী হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যেত।
রিরা কথাটি শুনতে পায় নি ভান করে হঠাৎ করে নিজের পায়ে বাধা শেকলের অংশগুলো খুলতে ব্যস্ত হয়ে গেল।
০৭. নীলমানব কুশান
নীলমানব কুশান এবং রিরা মিলে মহাকাশযানটাকে সুরক্ষিত করতে শুরু করে। মহাকাশযানের যেসব জায়গা ভেঙে ফঁকফোকর বা ফাটল তৈরি হয়েছিল, সেগুলো বুজিয়ে দিতে শুরু করল এই গ্রহটিতে বুদ্ধিহীন ভয়ংকর এবং নৃশংস এক ধরনের প্রাণী আছে, এরকম একটা তথ্য তারা জানে। সেই প্রাণী বা প্রাণীগুলো কী রকম সে সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। কাজেই তারা কোনোরকম ঝুঁকি নিতে চাইল না। বাইরে থেকে হঠাৎ করে কোনো প্রাণী ঢুকে গেলে তার সাথে রীতিমতো যুদ্ধ করার জন্য স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র বা ক্ষেপণাস্ত্র প্রস্তুত করে রাখল।
নীলমানব কুশানের সাথে কথা বলে রিরা আবিষ্কার করল, মানুষ কথা বলার সময় শুধু কণ্ঠস্বর নয়, চোখ-হাত খুলে এমনকি পুরো শরীর ব্যবহার করে। দুজনের পরিচিত শব্দের সংখ্যা খুব বেশি নয়, বেশ কিছু শব্দ অনুমান করে কাজ চালিয়ে নিতে হয় কিন্তু তারপরেও দুজনের কথাবার্তা বলতে খুব সমস্যা হল না। রিরা আবিষ্কার করল, নীলমানব কুশান বুদ্ধিমান এবং ধীরস্থির। এটি কি কুশানের নিজস্ব ব্যাপার নাকি নীলমানদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য—রিরা সে ব্যাপারে নিঃসন্দেই হতে পারল না।
দুজনে মিলে কাজ করতে কোনো অসুবিধা হল না মহাকাশযানটিকে সুরক্ষিত করার জন্য কুশানের নিজস্ব কিছু পরিকল্পনা ছিল। রিরা দ্বিধান্বিতভাবে তার ভেতরে কিছু কিছু পরিবর্তন করার কথা বলা মাত্রই কুশান সাথে সাথে সেগুলো মেনে নেয়। কুশানের জায়গায় একজন মানুষ হলে এত সহজে মেনে নিত না। মহাকাশযানের ক্যাপ্টেন বৰ্কেন বলেছিলেন, নীলমানব বিচ্ছিন্ন প্রাণীসত্তা নয়, তারা সব সময় একসাথে কাজ করে। এখানেও নিশ্চয়ই সেটি হচ্ছে, রিরা যখনই কোনো প্রস্তাব করছে কুশান সাথে সাথে সেটি মেনে নিচ্ছে। নীলমানবদের সে ভয়ংকর দুর্ধর্ষ এবং একরোখা জেনে এসেছে কিন্তু এই মহাকাশযানে দুজনে একসাথে আটকা পড়ে যখন একসাথে কাজ করতে হচ্ছে, তখন কুশানকে মোটেও একরোখা বা দুর্ধর্ষ মনে হচ্ছে না। মহাকাশযানটি দখল করার সময় এই কুশান এবং তার সঙ্গীসাথীরাই যে ভয়ংকর আক্রমণ চালিয়েছিল, কুশানকে দেখে সে কথাটি বিশ্বাসযোগ্যই মনে হয় না। কুশানকে দেখে মনে হয় একজন স্বল্পভাষী সহৃদয় মানুষ—ভয়ংকর একরোখা যোদ্ধা কিছুতেই নয়।
টাইটেনিয়ামের শক্ত দরজা দিয়ে যেসব করিডর এবং টানেল বন্ধ করা সম্ভব হল, দুজনে মিলে সেগুলো বন্ধ করে দিল। বড় বড় ফুটোগুলোতে ধাতব পাত লাগিয়ে ওয়েল্ড করে দেওয়া হল। বড় বড় ফুটোগুলো বন্ধ হবার পর দুজনে মিলে ফাটলগুলোতে ধাতব আকরিকের পেস্ট দিয়ে সেগুলো সিল করে দিতে শুরু করল। মহাকাশযানটি বিধ্বস্ত হবার পর তার প্রায় সব অ্যালার্ম সিস্টেম নষ্ট হয়ে গিয়েছে, দুজনে মিলে সেগুলোও আবার দাঁড় করাতে শুরু করল। মহাকাশযানটি মানুষের, প্রযুক্তিটিও মানুষের, তাই এ ধরনের কাজের সাথে কুশান পরিচিত নয়। তবে খুব দ্রুত সে কাজ শিখে নিতে পারে এবং আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় সে কাজে দক্ষ হয়ে উঠতে পারে। মহাকাশযানে কুশানের মতো একজন মহাকাশচারীকে পেয়ে যাওয়া নিশ্চয়ই রীতিমতো সৌভাগ্যের একটা ব্যাপার।
মহাকাশযানটিকে মোটামুটিভাবে সুরক্ষিত করে তারা প্রথমবার ভালো করে গ্রহটির দিকে নজর দেবার সুযোগ পেল। গ্রহটি একেবারেই সাদামাটা গ্রহ, বাইরে রুক্ষ পাথর ছাড়া আর কিছু নেই। বিশাল একটা উপগ্রহ থেকে বিচ্ছুরিত আলো গ্ৰহটাকে আলোকিত করে রেখেছে। এই উপগ্রহটির আলো কোথা থেকে আসছে, রিরা ভালো করে বুঝতে পারল না। তবে উপগ্রহের উপরের দিক থেকে কুণ্ডলী পাকানো আলোর বিচ্ছুরণ দেখে মনে হয় শক্তিশালী চৌম্বকীয় ক্ষেত্রে ইলেকট্রন এবং আয়ন আটকা পড়ে বিশাল একটা প্লাজমাক্ষেত্রের মতো কাজ করছে। সম্ভবত সেটাই আলো হিসেবে আসছে। আলোটা স্থির নয়, এটি বাড়ছে এবং কমছে। তার রঙেরও পরিবর্তন হচ্ছে, বেশিরভাগ সময়ে এটি উজ্জ্বল সাদা রঙের কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ কমলা রঙে পাল্টে যায়। রিরার মনে হতে থাকে দূরে কোথাও বুঝি আগুন লেগেছে এবং সেই আগুনের কমলা আভা এসে পড়ছে, রিরা তখন ভেতরে ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতা অনুভব করে। রিরা এক ধরনের হিংসা নিয়ে লক্ষ করেছে নীলমানবের ভেতরে কখনোই কোনো অস্থিরতা নেই। এক ধরনের কৌতূহলী শান্ত চোখে সে সবকিছু গভীর আগ্রহ নিয়ে লক্ষ করে, কোনো কিছু নিয়েই সে ব্যস্ত হয়ে ওঠে না।
প্রথমে কিছুদিন এক ধরনের অমানুষিক পরিশ্রম করে তারা মহাকাশযানটিকে মোটামুটি সুরক্ষিত করার পর অন্য বিষয়গুলোর দিকে নজর দিতে শুরু করে। এখানে তাদের কতদিন থাকতে হবে তারা জানে না, তাই খাবার সরবরাহের ব্যাপারটি নিশ্চিত করে নিল। বিদ্যুৎপ্রবাহ নিশ্চিত করার জন্য তারা অনেক সময় নিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকা। জ্বালানিটুকু সংরক্ষণের ব্যবস্থা করল। জ্বালানির যেন অপচয় না হয়, সেজন্য পুরো মহাকাশযান ঘুরে ঘুরে যেখানে প্রয়োজন নেই সেখানে বিদ্যুৎ এবং তাপপ্রবাহ বন্ধ করে দিল। ভেতরে অক্সিজেন সরবরাহের পাম্পটি দুজনে মিলে ওভারহল করে প্রায় নতুন করে ফেলল।