বলে লাভ নেই।
কেন?
সে এসব বোঝে না। নীলমানদের কালচার মানুষের কালচার থেকে ভিন্ন।
হোক। রিরা পাথরের মতো মুখ করে বলল, তুমি ওকে বলো একজন মানুষকে তার খাবার পা দিয়ে ঠেলে দেওয়া যায় না।
প্রসেসর বিজাতীয় ভাষায় কিছু একটা বলল এবং নীলমানবকে হঠাৎ একটু বিভ্রান্ত দেখায়। সে কয়েক মুহূর্ত একটা কিছু ভাবল, তারপর হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি তাক করে রিরার দিকে এগিয়ে এল। রিরার কাছাকাছি এসে সে খাবারের ট্রেটা হাতে নিয়ে রিরার দিকে এগিয়ে দেয়, নিচু গলায় বলে, অনুগ্রহ করে। কিশিমারা।
রিরা স্থিরদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ নীলমানবটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, কুগুরা। ধন্যবাদ।
নীলমানবটি দুই পা পিছনে সরে গিয়ে হেলান দিয়ে বসে রিরার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। রিরা খাবারের ট্রেটির দিকে তাকাল, একজন মানুষ যতটুকু খেতে পারে খাবার তার থেকে অনেক বেশি। নীলমানবদের খাবারের অভ্যাস নিশ্চয়ই অন্যরকম, কারণ ট্রেতে প্রোটিনের পরিমাণ অনেক বেশি। রিরা যেটুকু খেতে পারবে, আলাদা করে সরিয়ে বার্কি খাবারসহ ট্রেটা নীলমানবটির দিকে এগিয়ে দেয়। নীলমানটা অনিশ্চিতভাবে কিছুক্ষণ রিরার দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর এগিয়ে এসে খাবারের ট্রেটা হাতে নেয়। রিরা যখন খেতে শুরু করল তখন নীলমানবটিও খৈতে শুরু করল। নীলমানবের খাবারের ভঙ্গিটুকু এক বিচিত্র, খাবারের টুকরো যত ছোটই হোক কিংবা যত বড়ই হোক সেটা সে দুই হাতে ধরে খায়। কে জানে এর পেছনে হয়তো কোনো সংস্কার রয়েছে। তবে রিরার কৌতূহলটি হল অন্য ব্যাপারে, যে কোনো কারণেই হোক নীলমানবটি বসেছে তার কাছাকাছি, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা রেখেছে এমন জায়গায় যে রিরা ইচ্ছে করলে সেটা ধরে ফেলতে পারে। রিরা খেতে খেতে পুরো ব্যাপারটা একটু ভেবে দেখল নীলমানবটি কিছু সন্দেহ করছে না, অন্যমনস্কভাবে খাবার মুখে তুলছে। রিরা বাম হাত দিয়ে ইচ্ছে করলেই এক ঝটকায় স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা তুলে নিতে পারে সাথে সাথে এই মহাকাশযানে পুরো সমীকরণটি পাল্টে যাবে। যদি তুলতে না পারে তা হলে একটা ঝামেলা হতে পারে কিন্তু সেটা নিয়ে এখন চিন্তা না করাই ভালো। রিরা চোখের কোনা দিয়ে নলিমানবটিকে লক্ষ করল এবং যখন সে দু হাতে এক টুকরো প্রোটিন হাতে নিয়েছে রিরা তখন ঝাঁপিয়ে পড়ল স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটির ওপর।
নীলমানবটি হকচকিয়ে গিয়ে যখন কী হচ্ছে বুঝতে পেরেছে তখন খুব দেরি হয়ে। গেছে। রিরার হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র এবং ট্রিগারে আঙুল। সে হিংস্র গলায় বলল, দুই হাত উপরে নীলমানব।
নীলমানবটি কী করবে বুঝতে পারছিল না, রিরা তখন অধৈর্য গলায় চিৎকার করে উঠল, হাত উপরে।
নীলমানবটি ইতস্ততভাবে হাত উপরে তুলল। রিরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ঝাকুনি দিয়ে বলল, দেয়ালের কাছে যাও। নীলমানবটি বিভ্রান্ত হয়ে দুই হাত উপরে তুলে দেয়ালের কাছে এগিয়ে যায়। দেয়ালে হেলান দিয়ে সে এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে রিরার দিকে তাকিয়ে রইল।
প্রসেসর হঠাৎ শিস দেওয়ার মতো একটা শব্দ করে বলল, চমৎকার।
রিরা কোনো কথা বলল না। প্রসেসর আবার বলল, গুলি কর রিরা। অস্ত্রটি তার হৃৎপিণ্ডের দিকে তাক করে গুলি কর। তুমি আরো একবার সুযোগ পেয়ে আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি আর এই সুযোগ পাবে না।
রিরা অস্ত্র তাক করে দাঁড়িয়ে রইল, প্রসেসর আবার বলল, গুলি কর রিরা। গুলি
কর।
রিরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি নিজের পায়ের দিকে তাক করে শেকল লক্ষ করে গুলি করল, বন্ধ ঘরের মাঝে ভয়ংকর শব্দে সেই অস্ত্রের বিস্ফোরণের শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল। নীলমানব নিষ্পলক দৃষ্টিতে রিরার দিকে তাকিয়ে রইল, প্রসেসর আবার বলল, রিরা, গুলি কর। হত্যা কর নীলমানবকে।
রিরা নিজেকে মুক্ত করে নীলমানবের দিকে এগিয়ে গেল, পায়ে বাধা শেকলের অংশ নূপুরের মতো শব্দ করে ওঠে। প্রসেসর চাপা গলায় বলল, দেরি করো না, রিরা। এই সুযোগ আর তুমি পাবে না।
রিরা এক মুহূর্ত দ্বিধা করে তারপর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি নীলমানবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নাও।
নীলমানবটি এক ধবনের বিস্ময় নিয়ে রিরার দিকে তাকিয়ে থাকে, এখনো সে বিশ্বাস করতে পারছে না রিরা কী করতে চাইছে। রিরা আবার বলল, নাও।
নীলমানবটি নিজের বুকে হাত দিয়ে বলল, আমি অস্ত্র?
হ্যাঁ, আমি তোমাকে এই স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি দিচ্ছি। আমি আমার পায়ের শেকল খোলার জন্য নিয়েছিলাম, শেকল খুলেছি, এখন আর প্রয়োজন নেই। তোমার অস্ত্র তুমি নাও।
নীলমানব কী বুঝল কে জানে, সে হাত বাড়িয়ে অস্ত্রটি নিল এবং হঠাৎ হেসে ফেলল। ঝকঝকে সাদা দাঁত এবং এক ধরনের ভালো মানুষের মতো হাসি—রিরা হঠাৎ আবার বুঝতে পারে নীলমানবটি অসম্ভব রূপবান।
নীলমানবটি অস্ত্র হাতে নিয়ে কয়েক মুহূর্ত আড্রষ্টের মতো দাঁড়িয়ে থাকে, সেটি কী করবে যেন বুঝতে পারে না। ইতস্তত করে সে দুই পা এগিয়ে বিছানার উপর অস্ত্রটি রেখে রিরার কাছে ফিরে এল, রিরা তার হাতটি বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আমার নাম রিরা।
নীলমানবটি রিরার হাত ধরে নবম গলায় বলল, আমি কুশান।
তোমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম কুশান।
কুশান বিড়বিড় করে কী যেন বলল, রিরা ঠিক বুঝতে পারল না। রিরা সেটা নিয়ে মাথা ঘামাল না, বলল, এই মহাকাশযানে অনেক লাল এবং নীল রক্তক্ষয় হয়েছে। সেটা যথেষ্ট। আশা করছি আমি এবং তুমি সেই নির্বুদ্ধিতার কথা ভুলে যাব।