তুমি বলেছিলে সে আমাকে গুলি করে মারবে।
মূল প্রসেসর ধাতব গলায় বলল, তার সময় এখনো শেষ হয়ে যায় নি। তুমি ভুলে যেও না তোমার দুই পা শিকল দিয়ে বাধা। তোমাকে হত্যা করতে তার এক সেকেন্ড সময়ও লাগবে না।
কিন্তু—
মূল প্রসেসর রিরাকে বাধা দিয়ে বলল, নীলমানব এদিকে আসছে।
রিরার গলার স্বর কেঁপে উঠল, সে কি সশস্ত্র?
হ্যাঁ। তার হাতে একটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র।
রিরা একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে তার বিছানায় গিয়ে বসে। একটু আগেই নীলমানব ছিল তার হাতে বন্দি, এখন সে নীলমানবের হাতে বন্দি।
খুট করে একটা শব্দ হল, তারপর খুব ধীরে ধীরে দরজা খুলে গেল। রিরা তাকিয়ে দেখল ঘরের দরজায় দীর্ঘদেহী নীলমানবটি পাথরের মতো মুখ করে তাকিয়ে আছে। তার ডান হাতে আলগোছে একটা স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র ধরে রাখা। রিরা তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, তুমি আমাকে কেন শেকল দিয়ে বেঁধে রেখেছ?
নীলমানবটি তার কথা বুঝতে পারল কি না বোঝা গেল না, কিন্তু সে উত্তর দেবার কোনো চেষ্টা না করে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। রিরা উচ্চকণ্ঠে ডাকল, প্রসেসর… প্রসেসর…
বলো।
তুমি কি নীলমানবের ভাষা জান?
জানি।
তুমি আমার প্রশ্নটি অনুবাদ করে দাও।
রিরা শুনতে পেল কোনো একটি বিজাতীয় ভাষায় প্রসেসর তার প্রশ্নটি অনুবাদ করে দিচ্ছে। প্রশ্নটি শুনে নীলমানব খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকল, তারপর কিছু একটা উত্তর দিল। রিরা জিজ্ঞেস করল, কী বলেছে সে?
প্রসেসর বলল, সে বলেছে তুমি যে কারণে আমাকে বন্দি করে রেখেছিলে, আমি ঠিক সেই কারণে তোমাকে বন্দি করে রেখেছি।
রিরা চিৎকার করে বলল, তাকে বলল এটা আমাদের মহাকাশযান তার না। আমার তাকে বন্দি করে রাখার অধিকার আছে। তার নেই।
মূল প্রসেসর রিরার কথাটির অনুবাদ করে শুনিয়ে দিল এবং তখন প্রথমবার নীলমানবটিকে হাসতে দেখল। নীলমানবটির চেহারা নিষ্ঠুর কিন্তু হাসার সময় এটা রিরা স্বীকার না করে পারল না সে অত্যন্ত সুদর্শন।
নীলমানবটি কিছু একটা বলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে উদ্যত হল। রিরা জিজ্ঞেস করল, কী বলেছে সে?
তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়।
কিন্তু আমি শুনতে চাই।
সে বলেছে তোমার কথাবার্তা অল্পবয়সী শিশুর মতো।
রিরা নিশ্বাস আটকে রেখে বলল, তাই বলেছে?
হ্যাঁ।
তাকে বলে এই মুহূর্তে আমার পায়ের শেকল খুলে দিতে।
বলে কোনো লাভ হবে না রিরা।
লাভ না হলে নাই। তাকে বলো।
মূল প্রসেসর নীলমানরটিকে তার ভাষায় শেকল খুলে দিতে বলল। সাথে সাথে নীলমানবের মুখমণ্ডল কঠোর হয়ে ওঠে, হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ঝাঁকিয়ে কিছু একটা বলে, সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। রিরা জিজ্ঞেস করল, কী বলেছে নীলমানব?
বলেছে অর্থহীন কথা বলে শক্তিক্ষয় না করতে। তাই বলেছে?
হ্যাঁ। তারপর বলেছে এই মুহূর্তে তোমাকে হত্যা করার তার কোনো পরিকল্পনা নেই। কিন্তু তুমি যদি বাড়াবাড়ি কর, তা হলে সে তার মত পরিবর্তন করতে পাবে।
রিরার ভেতরে এক ধরনের অক্ষম ক্রোধ পাক খেতে থাকে। সে দাতে দাঁত ঘষে বলল, সে এখন কোথায় যাচ্ছে? কী করছে?
সব সময় যা করে।
সব সময় কী করে?
মহাকাশযানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। যত জায়গা ভেঙেচুরে গেছে সেগুলো বন্ধ করছে। অস্ত্র হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
কেন?
কেউ যেন ঢুকতে না পারে।
রিরা নিশ্বাস বন্ধ করে বলল, কে ঢুকবে এখানে?
তোমাকে আগেই বলেছি, এখানে বুদ্ধিহীন নৃশংস ভয়ংকর এক ধরনের প্রাণী থাকে।
রিরা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ, তুমি বলেছিলে। এখন সেটা খুব কাছের ব্যাপার হয়ে গেছে।
রিরা বিষদৃষ্টিতে তার পায়ের শেকলের দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর দুই হাতে ভর দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। ক্যাপ্টেনের ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, প্রসেসর।
বলো।
এই গ্রহের কি কোনো নাম আছে?
আগে ছিল। এখন নেই, এখন শুধু একটি সংখ্যা।
এই গ্রহের প্রাণীগুলো কী রকম তুমি জান?
না, জানি না।
কিছুই জান না?
না, কিছুই জানি না। মহাকাশযানটা যখন বায়ুমণ্ডলের ভেতর দিয়ে নামিয়ে এনেছ, তখন প্রচণ্ড উত্তাপে বাইরের দিকের সবকিছু জ্বলেপুড়ে শেষ হয়ে গেছে। সেখানে আমাদের সব সেন্সর ছিল। সেন্সরগুলো থাকলে আমি এই গ্রহটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে পারতাম। এখন আমি কিছু করতে পারি না, কিছু দেখতে পারি না।
শুধু মহাকাশযানের ভেতরে দেখতে পার?
হ্যাঁ, মহাকাশযানের ভেতর্বকার ক্যামেরাগুলো নষ্ট হয় নি—ভেতরে দেখতে পারি।
রিরা একটা নিশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করল, নীলমানব এখন কী করছে?
এতক্ষণ মহাকাশযানের সামনে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল। কয়েকটা। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র বসিয়ে এসেছে। এখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পিছন দিকে যাচ্ছে, ঘাড়ে করে বেশ কয়েকটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে যাচ্ছে।
তুমি বলতে চাও নীলমানবটা কোনো বিশ্রাম নেয় না?
না।
খায় না?
না, এখনো খেতে দেখি নি।
ঘুমায় না?
এখনো ঘুমায় নি।
রিরা কোনো কথা না বলে ছাদের দিকে মাথা রেখে দুই হাতের উপর শুয়ে রইল।
নীলমানব খায় না বা ঘুমায় না—কথাটা পুরোপুরি সত্যি নয়। ঘণ্টা ছয়েক পরে সে একটা খাবারের ট্রে নিয়ে হাজির হল। মেঝেতে রেখে সে ট্রেটা পা দিয়ে রিরার দিকে ঠেলে দিল। রিরা চাপা গলায় বলল, প্রসেসর।
বলো।
ওকে বলো একজন মানুষকে পা দিয়ে খাবার ঠেলে দেওয়া যায় না। সেটা অসম্মানজনক।