আমি জানি।
তা হলে?
একটা নীলমাকে একটা ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখা আছে। তালাটা খুলে দিই।
কেন?
মহাকাশযান বিধ্বস্ত হয়ে গেলে সে খাঁচায় আটকে পড়া ইঁদুরের মতো মারা যাবে।
তাতে কী আসে যায়? নীলমানব মানুষ নয়—তাদের জীবন রক্ষা করার দায়িত্ব তোমার নয়। তা ছাড়া–
তা ছাড়া কী?
তা ছাড়া সে মুক্ত হতে পারলে নিশ্চিত তোমাকে হত্যা করবে।
রিরা কয়েক মুহূর্ত দ্বিধা করে বলল, তোমার তা-ই ধারণা?
এটি আমার ধারণা নয়। আমি নিশ্চিতভাবে জানি। আমি চাই তুমি সুযোগ। থাকতেই তাকে গুলি করে হত্যা কর। সরাসরি মস্তিষ্কে আট পয়েন্টের একটি গুলি। করা হলে হত্যাকাণ্ডটি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে। তুমি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি নিয়ে যাও।
স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি নিয়ে যাব?
হ্যাঁ। মহাকাশযানের মূল প্রসেসর তার যান্ত্রিক কণ্ঠে খানিকটা ব্যস্ততার ভাব ফুটিয়ে বলল, কোনো একটা উঁচু পাথরে আঘাত লেগে মহাকাশযানটি বিধ্বস্ত হয়ে গেলে বন্দি নীলমানবটির ঘরের দরজা বা দেয়াল ভেঙে যেতে পারে, সে তখন বের হয়ে আসতে পারে।
রিরা দ্বিধান্বিতভাবে বলল, কিন্তু—
কিন্তু কী?
মানুষকে যেসব জিনিস শেখানো হয়, তার একটি হচ্ছে কখনো বন্দি মানুষকে হত্যা না করা। তার চাইতে বড় কোনো কাপুরুষতা হতে পারে না।
নীলমানব মানুষ নয়। তাকে ভিন্ন কোনো প্রাণী হিসেবে বিবেচনা করতে পার।
রিরা মাথা নাড়ল, বলল, বন্দি হচ্ছে বন্দি। মানুষ কিংবা অন্য যে কোনো প্রাণীই হোক কেন।
মহাকাশযানের মূল প্রসেসব কঠোর কণ্ঠে বলল, তোমার এই ছেলেমানুষি যুক্তির কারণে তুমি ভয়ংকর বিপদগ্রস্ত হবে।
রির উত্তরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ করে প্রচণ্ড আঘাতে পুরো মহাকাশযানটি কেঁপে উঠল। ভয়ংকর শব্দে তার কানে তালা লেগে যায়, মহাকাশযানটি পাক খেয়ে উল্টে যেতে থাকে প্রচণ্ড আঘাতে রিরা ছিটকে পড়ে। বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেল সে—মহাকাশযানটি দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙেচুরে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। রিরার মনে হতে থাকে সে কোথাও পড়ে যাচ্ছে হাত বাড়িয়ে কিছু একটা ধরার চেষ্টা করে কিন্তু কিছুই ধরতে পারে না সে। কেউ একজন চিৎকার করছে অমানুষিক গলায়, কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যাচ্ছে মহাকাশযানটি, পোড়া গন্ধে নিশ্বাস নিতে পারছে না রিরা। কিছু একটা প্রচণ্ড শব্দে ভেঙে পড়ল, আগুনের হলকার মতো কিছু একটা অনুভব করল রিরা। ভয়ংকর অমানুষিক যন্ত্রণায় শরীরের ভেতরে কুঁকড়ে উঠতে থাকে। মহাকাশযানের আলো নিভে গেল হঠাৎ রিরা ওঠার চেষ্টা করতে থাকে কিন্তু উঠতে পারে না। কোনো একটা ধাতব বিমের নিচে আটকা পড়ে গেছে। প্রাণপণে বের হতে চেষ্টা করছে কিন্তু বের হতে পারছে না, শরীরের একটা অংশ আটকা পড়ে গেছে তার। ঘুটঘুটে অন্ধকারে দেখার চেষ্টা করছে রিরা কিন্তু সে কিছুই দেখতে পারছে না। খানিকটা বাতাসের জন্য বুকের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে কিন্তু সে নিশ্বাস নিতে পারছে না। অমানুষিক যন্ত্রণায় চিৎকার করতে চেষ্টা করে কিন্তু তার গলা থেকে কোনো আওয়াজ বের হয় না।
রিরা হঠাৎ করে অনুভব করে, গাঢ় অন্ধকারে সে তলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। মনে হতে থাকে আর কখনোই সে এই অন্ধকার থেকে বুঝি উঠে আসতে পারবে না।
০৬. রিরার জ্ঞান ফিরে আসে
খুব ধীরে ধীরে রিরার জ্ঞান ফিরে আসে। মহাকাশযানের ভেতর সব সময়ই অল্প কম্পনের একটা শব্দ হতে থাকে। সেই শব্দটা এখন নেই। যে শক্তিশালী কুরু ইঞ্জিনটি মহাকাশযানটিকে উড়িয়ে নিয়ে এসেছে, এই প্রথমবার সেই ইঞ্জিনটি বন্ধ হয়ে গেছে, হঠাৎ করে পুরো মহাকাশযানে একটি বিস্ময়কর নৈঃশব্দ্য নেমে এসেছে। রিরা মনে করতে চেষ্টা করে সে কোথায়, তার কী হয়েছে। সে মহাকাশযানটিকে অবতরণ করানোর চেষ্টা করছিল, মহাকাশযানের বিশাল দুটি পাখা বের হয়ে এসেছিল, খুব ধীরে ধীরে সেটি নেমে আসছিল, ঠিক তখন এক ভয়ংকর বিস্ফোরণের শব্দ হল–
হঠাৎ রিরার সব কথা মনে পড়ে যায়, লাফিয়ে উঠে বসে সে। চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে ক্যাপ্টেনের ঘরে নরম বিছানায় শুয়ে আছে সে। কে এনেছে তাকে এখানে?
রিরা বিছানা থেকে নামার চেষ্টা করে হঠাৎ মুখ থুবড়ে নিচে পড়ে গেল, অবাক হয়ে আবিষ্কার করল তার দুই পা শেকল দিয়ে বাধা। রিরা হতচকিত হয়ে নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে, কে তাকে বেঁধে রেখেছে এখানে? রিরা কাপা গলায় ডাকল, প্রসেসর… প্রসেসর…।
ক্যাপ্টেনের ঘরে প্রসেসর শুষ্ক গলায় উত্তর দিল, বলো রিরা।
আমাকে কে বেঁধে রেখেছে?
তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে, তোমার এটি জানার কথা।
নীলমানব?
হ্যাঁ। আমি বলেছিলাম তাকে হত্যা করতে তুমি রাজি হলে না। এখন তার মূল্য দিচ্ছ।
সে কেমন করে বের হল?
মহাকাশযানটি যখন বিধ্বস্ত হয়েছে, তখন তার ঘরের দরজা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সে তখন তার দরজা ভেঙে বের হয়ে এসেছে।
কিন্তু… তার পায়ে গুলি লেগেছিল?
মূল প্রসেসর একমুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, সে খুঁজে খুঁজে মেডিক্যাল কিট বের করে পায়ে ব্যান্ডেজ করেছে। যন্ত্রণা কমানোর জন্য নিথিলিন ইনজেকশন নিয়েছে, তারপর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে হেঁটে সবকিছু করেছে।
রিরা বড় বড় দুটি নিশ্বাস ফেলে বলল, আমাকে টেনে বের করে এনেছে?
হ্যাঁ, তুমি একটা বিমের নিচে আটকা পড়েছিলে, অনেক কষ্ট করে সেই বিমের নিচে থেকে টেনে বের করে এনেছে।