মহাকাশযানটি থরথর কাঁপছে, রিরা মনিটরে দেখতে পায় আগুনের ফুলকির মতো ছোট ছোট ধাতব কণা মহাকাশযানের পাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে। হঠাৎ একটা বিস্ফোরণের শব্দ হল, ভয়ংকর ঝাকুনি দিয়ে পুরো মহাকাশযানটি প্রায় উল্টে যেতে গিয়ে আবার স্থির হয়ে গেল সম্ভবত একটি এন্টেনা বাতাসের ঝাঁপটায় ভেঙে উড়ে গেছে, খুব সাবধানে সে বুকের ভেতরে চাপা থাকা একটা নিশ্বাস বের করে দেয়।
রিরা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মনিটরের দিকে তাকিয়ে গতিবেগ দেখতে থাকে, ধীরে ধীরে সেটি কমতে শুরু করেছে। ঘণ্টায় হাজার কিলোমিটারে নেমে আসার পর সে মহাকাশযানের দুটি পাখা বের করে দেবার চেষ্টা করবে। যেহেতু এখানে বায়ুমণ্ডল আছে সে সেখানে ভেসে থাকার সুযোগটা নিতে চায়।
আবার একটা ভয়ংকর বিস্ফোরণের শব্দ হল, মহাকাশযানটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে যেতে শেষমুহূর্তে নিয়ন্ত্রণে চলে এল। ভয়ংকর ঝাঁকুনি দিতে শুরু করেছে, ভেতরে বিকট শব্দ হচ্ছে, মনে হচ্ছে বিশাল এই মহাকাশযানটিকে কেউ যেন দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলছে। ভেতরের তাপমাত্রা বেড়ে যেতে শুরু করেছে, তার সাথে একটা পোড়া গন্ধ। এভাবে বেশিক্ষণ চলতে থাকলে পুরো মহাকাশযানটি জ্বলেপুড়ে শেষ হয়ে যাবে। রিরা নিশ্বাস বন্ধ করে মহাকাশযানের কন্ট্রোল স্টিয়ারিং ধরে রাখে, খুব ধীরে ধীরে গতিবেগ কমে আসছে, শব্দের গতিবেগের নিচে নেমে আসার পর ভয়ংকর শব্দে সনিক বুমটি শুনতে পেল—রিরা বুকের ভেতর আটকে থাকা নিশ্বাসটি বের করে দেয়, বিপদের প্রথম ধাক্কাটি শেষ হয়েছে বায়ুমণ্ডল ভেদ করে সে মহাকাশযানটিকে গ্রহের ভেতরে নিয়ে এসেছে। এখন দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। মহাকাশযানটিকে শক্ত মাটির উপরে নামানো। একটু ভুল হলেই এটি মুহূর্তের মাঝে বিধ্বস্ত হয়ে যাবে।
রিরা মনিটরের দিকে তাকাল, এটি দ্রুত নিচে নামছে—এই গতিতে নিচে নামতে থাকলে কোনোভাবেই মহাকাশযানটিকে রক্ষা করা যাবে না। রিরা কন্ট্রোলরুমের স্টিয়ারিং টেনে পাখা দুটো বের করার চেষ্টা করল, শক্ত স্টিয়ারিং নড়তে চায় না, পুরো শরীর দিয়ে ধাক্কা দিয়ে শেষ পর্যন্ত টেনে আনতে পারল, প্রায় সাথে সাথে সে ঘরঘর একটা শব্দ শুনতে পায়। মহাকাশযানের মূল ইঞ্জিন তার মোটর চালু করে পাখা দুটো বের করতে শুরু করেছে। রিরা নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে, মোটরের ঘরঘর শব্দ বন্ধ হবার পর সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। মহাকাশযানটিকে রক্ষা করার সম্ভাবনা এখন আরো কয়েক গুণ বেড়ে গেছে।
বিশাল পাখা মেলে অতিশয় একটা পাখির মতো এই মহাকাশযানটি নিচে নেমে আসতে শুরু করেছে। পাখার নিচে ছোট ছোট জেট ইঞ্জিন রয়েছে, থেমে যাবার আগের মুহূর্তে সেগুলো চালু হয়ে মহাকাশযানটিকে সাবধানে নিচে নামিয়ে আনার কথা। কতগুলো জেট চালাতে পারবে সেটি রিরা জানে না, নীলমানদের সাথে সংঘর্ষের সময় তাদের অনেক জ্বালানি নষ্ট হয়েছে।
রিরা তীক্ষ্ণ চোখে মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকে—এতক্ষণ পর্যন্ত সবকিছু পরিকল্পনা মতো কাজ করেছে—যদিও একেবারে শেষ অংশটুকু হচ্ছে সবচেয়ে কঠিন এবং সবকিছু পরিকল্পনা মতো কাজ করা পুরোপুরি অর্থহীন হয়ে যাবে, যদি শেষটুকু ঠিকভাবে সমাপ্ত না হয়। রিরা এই দীর্ঘসময় একটিবারও মূল প্রসেসরের সাথে কথা বলে নি—এই প্রথম সে খানিকটা সময় পেয়েছে। চাপা গলায় সে ডাকল, প্রসেসর।
বলো রিরা।
সবকিছু কি ঠিক আছে?
প্রায়।
প্রায় কেন বলছ?
মহাকাশযানের দুটি পাখা অনেকটুকু জায়গা নিয়ে নিয়েছে।
সে তো নেবেই। এত বড় মহাকাশযানকে ভাসিয়ে রাখতে হলে কয়েক কিলোমিটার লম্বা পাখা লাগার কথা।
মূল প্রসেসর শান্ত গলায় বলল, আমি এবোডিনামিক্স নিয়ে প্রশ্ন করছি না।
তা হলে কী নিয়ে প্রশ্ন করছ?
মহাকাশযানটিকে সফলভাবে নামার ব্যাপারে প্রশ্ন করছি।
রিরা নিশ্বাস বন্ধ করে বলল, সফলভাবে নামার ব্যাপারে তোমার কী প্রশ্ন?
এটি একটি পাথুরে গ্রহ। পুরো গ্রহটিতে উঁচু-নিচু পাথর। তার একটা বড় সমস্যা আছে।
রিরা দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে বলল, পাথরের আঘাত খেয়ে পাখা ভেঙে যাবে?
হ্যাঁ।
কত উঁচুতে ভাঙবে?
একেবারে নিখুঁতভাবে বলা যাচ্ছে না। গ্রহটাতে এক ধরনের ঝড়ো হাওয়া বইছে, মহাকাশযানটা ঠিক কোথায় নামবে বলা যাচ্ছে না। রাডার জ্বলেপুড়ে গেছে—কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই নিশ্চয়ই জান।
রিরা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তুমি এটা আমাকে আগে কেন বলো নি?
বলে লাভ কী? শুধু শুধু তুমি পুরো সময়টা দুশ্চিন্তা করতে। এখন দুশ্চিন্তা করবে শেষ কয়েকটি মুহূর্ত।
শেষ মুহূর্ত কি চলে এসেছে?
হ্যাঁ। আমার সুপারিশ হবে তুমি এখন মহাকাশযানের নিরাপত্তা পোশাক পরে নাও। আর সময় নেই।
রিরা উঠে দাঁড়াল। মনিটরের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ সে আতঙ্ক অনুভব করে। গ্রহটির অনেক নিচে নেমে এসেছে। যে গ্ৰহটাকে মহাকাশ থেকে মোটামুটি সমতল মনে হয়েছে মাটির কাছাকাছি এসে দেখা যাচ্ছে সেটা মোটেও সমতল নয় বড় বড় পাথর ছড়িয়েছিটিয়ে আছে। হঠাৎ হঠাৎ অনেক পাথর উঁচু হয়ে আছে। নিয়ন্ত্রণহীন একটা বড় পাখির মতো মহাকাশযানটি নিচে নেমে আসছে। ঠিক সোজাসুজি নামছে না, দুলতে দুলতে নামছে। মহাকাশযানের মাঝে আর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না।
রিরা সাবধানে দেয়াল ধরে অগ্রসর হতে শুরু করে। মূল প্রসেসর বলল, তুমি উল্টোদিকে যাচ্ছ রিরা, নিরাপত্তা পোশাকগুলো অন্যদিকে রাখা।