কিন্তু কী?
কোনো একটি অজ্ঞাত কারণে কলোনির সবাই মারা পড়েছিল। কারণটা বের করতে পারে নি মানুষ আর কখনো ফিরে আসে নি।
রিরা ভুরু কুঁচকে বলল, আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছ?
না রিরা। আমি ভয় দেখানোর চেষ্টা করছি না, তোমাকে শুধু জানিয়ে রাখছি।
অনেক ধন্যবাদ সেজন্য। রির অন্যমনস্কভাবে টেবিলে আঙুল দিয়ে কয়েকবার শব্দ করে বলল, এই গ্রহের সব মানুষ কেন মারা পড়েছিল, সেটা নিয়ে কোনো তথ্য আছে?
না নেই। মহাকাশযানের প্রসেসর তার শুকণ্ঠে বলল, তবে অসমর্থিত একটা তথ্য আছে।
সেটা কী?
এই গ্রহে কোনো এক ধরনের প্রাণের বিকাশ ঘটেছে। বুদ্ধিহীন, ভয়ংকর এবং নৃশংস প্রাণী।
রিরা একটা নিশ্বাস ফেলল, বলল, আমার জীবনে যেন যথেষ্ট উত্তেজনা নেই—এখন। বুদ্ধিহীন ভয়ংকর নৃশংস প্রাণীর সাথে সময় কাটাতে হবে! কপালটা দেখেছ? এর চাইতে ভালো কোনো গ্রহ আছে?
না। অন্য গ্রহগুলো বড় এবং অস্থিতিশীল। জি-এর মান এত বেশি যে নিজের শরীরের ওজনেই মারা পড়বে।
বেশ, তা হলে বুদ্ধিহীন ভয়ংকর এবং নৃশংস প্রাণীর গ্রহটাতেই নামার ব্যবস্থা কর।
কাজটি জটিল এবং বিপজ্জনক।
আমি জানি। রিরা হাসার চেষ্টা করে বলল, বেঁচে থাকার প্রক্রিয়াটাই জটিল এবং বিপজ্জনক। তবুও কি আমরা বেঁচে থাকার চেষ্টা করি না?
মহাকাশযানের কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নষ্ট হয়েছে—অবতরণ করাটি প্রায় দুঃসাধ্য।
তুমি কিছু চিন্তা করো না রিরা মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, আমি তোমাকে সাহায্য করব।
তুমি আমাকে সাহায্য করবে?
হ্যাঁ। এত অবাক হচ্ছ কেন?
মূল প্রসেসর শুষ্ক এবং ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলল, আমি অবাক হচ্ছি না। সত্যি কথা বলতে কী, অবাক বা রাগ হওয়ার মতো মানবিক ক্ষমতাগুলো আমাদের নেই। তবে ঘোর অবাস্তব পরিকল্পনা আমরা নিরুৎসাহিত করি।
আমরা করি না। রিরা গলায় খানিকটা উৎফুল্ল ভাব ফুটিয়ে বলল, মহাকাশ একাডেমিতে বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে মহাকাশযান অবতরণের ওপরে আমার একটি কোর্স ছিল। দেখা যাক যেসব বিষয় শিখিয়েছে সেটা সত্যি কি না!
মহাকাশযানের মূল প্রসেসর কোনো কথা না বলে শুধুমাত্র একটা যান্ত্রিক দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ করল।
প্রথমে মহাকাশযানটিকে গ্রহের কক্ষপথে আটকে নিতে হল, পুরো কাজটি ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক। নিউট্রন স্টারের পাশ দিয়ে যাবার সময় এটি যে বিশাল গতিবেগ সঞ্চয় করেছে, তার প্রায় পুরোটুকুই কমিয়ে আনতে হল। ক্ষতিগ্রস্ত ইঞ্জিন দিয়ে সেই কাজটি করা খুব কঠিন। প্রথম কক্ষপথটি হল বিশাল, খুব ধীরে ধীরে সেই কক্ষপথ ছোট করে আনতে শুরু করে। গ্রহের বায়ুমণ্ডলের ঠিক বাইরে পুরোপুরি বৃত্তাকার কক্ষপথে মহাকাশযানটিকে আবদ্ধ করে নেওয়ার পর রিরা গ্রহটির খুঁটিনাটির দিকে নজর দিল। উঁচু-নিচু পাথরে ঢাকা বিশাল একটি গ্রহ, একটা বড় অংশ সাদা বালু দিয়ে ঢাকা। মহাকাশযানটিকে নামানোর জন্য একটা সমতল জায়গা প্রয়োজন। শেষবার মানুষ যেখানে বসতি করেছিল, তার আশপাশে নামতে পারলে সবচেয়ে ভালো, অনেক ভাবনা-চিন্তা করে নিশ্চয়ই জায়গাটা ঠিক করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত অবিশ্যি কোনো মানুষই বেঁচে থাকে নি—তবে সেটা ভিন্ন কথা। সেটা নিয়ে পরে দুশ্চিন্তা করলেও হবে।
মহাকাশযানটি প্রতি ঘণ্টায় একবার পুরো গ্রহটি প্রদক্ষিণ করছে শক্তিশালী টেলিস্কোপ দিয়ে রিরা গ্ৰহটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। বুদ্ধিহীন ভয়ংকর এবং নৃশংস প্রাণী থাকার কথা কিন্তু মহাকাশ থেকে সেগুলো চোখে পড়ল না।
গ্রহটিতে বেশ লম্বা একটা সমতল জায়গা খুঁজে বের করে রিরা মহাকাশযানের মূল প্রসেসরের সাথে কথা বলতে শুরু করে। বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করার পর প্রচণ্ড ঘর্ষণে মহাকাশযানের বাইরের অংশ ভয়ংকর উত্তপ্ত হয়ে উঠবে, অন্য সময় সেটি একটি বড় সমস্যা, কিন্তু এখন রিরা সেটি নিয়ে মাথা ঘামাল না এই মহাকাশযানটিকে অক্ষত রাখার কোনো কারণ নেই, গতিবেগ কমিয়ে কোনোভাবে গ্রহটির শক্ত মাটিতে নামিয়ে স্থির করতে পারলেই হবে—তার ফলে মহাকাশযানের যে ক্ষতি হয় হোক! বিশাল মহাকাশযানের দুইতিনটি ছোট কেবিন অক্ষত থাকলেই সে দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকতে পারবে। এই মহাকাশযানটি নিয়ে সে এমনিতেই আর কখনো মহাকাশে উঠতে পারবে না।
বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করতে শুরু করার পর হঠাৎ রিরার নীলমানবটির কথা মনে পড়ল। পরবর্তী এক ঘণ্টা অত্যন্ত বিপজ্জনক সময় মহাকাশযানের মূল প্রসেসরের হিসেবে ঠিকভাবে অবতরণ করার সম্ভাবনা শতকরা মাত্র দশ ভাগ। এই সময়টিতে মহাকাশযান নানারকম ঝড়-ঝাঁপটার মাঝে পড়বে। মহাকাশচারীদের বিশেষ পোশাক পরে জীবন। সংরক্ষণ মডিউলে বসে থাকার কথা—রিরা নিজেও তার কিছু করে নি। নীলমানবটির অবস্থা আরো খারাপ; একটা ছোট ঘরে তালাবদ্ধ অবস্থায় আছে। যদি বড় দুর্ঘটনা হয়, নীলমানবটি খাচায় আটকে থাকা ইঁদুরের মতো মারা পড়বে। রিরা জোর করে তার মাথা থেকে চিন্তাটি সরিয়ে দিল।
বিশাল মহাকাশযানটি বায়ুমণ্ডলের ভেতরে ঢুকতে শুরু করেছে, বাতাসের ঘর্ষণে মহাকাশযানের বাইরের অংশ উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে। রিরা মনিটরে দেখতে পেল, তাপমাত্রা বিপজ্জনক সীমার কাছে পৌঁছে গেছে। বাতাসের ঝাঁপটাটি এসে লাগছে মহাকাশযানের নিচের অংশে—বিশেষ তাপ অপরিরাহী পদার্থ দিয়ে তৈরি অংশটুকু আগুনের মতো গরম হয়ে উঠেও তাপকে ভেতরে যেতে দিচ্ছে না। রিরা মহাকাশযানের ভেতরে এখনো কোনো বাড়তি তাপমাত্রা অনুভব করছে না।