হ্যাঁ। নীলমানবটি হাত দিয়ে তার পায়ের ক্ষতে ইনজেকশন দেবার ভঙ্গি করে বলল, কিশিমারা… অনুগ্রহ… কিজুন।
রিরা ভুরু কুঁচকে বলল, কিজুন মানে ওষুধ? তোমার পায়ের জন্য ওষুধ দরকার?
নীলমানবটি জোরে জোরে মাথা নাড়ল। রিরা কঠিন মুখে বলল, এরপর তুমি কী বলবে? ঘুমানোর জন্য নরম বিছানা? নেশা করার জন্য উত্তেজক ড্রাগ? দেশে ফিরে যাবার জন্য স্কাউটশিপ?
রিরা কী বলছে নীলমানবটি ঠিক বুঝতে পারল না, কিন্তু গলার স্বরে ক্রোধটি অনুভব করে এক ধরনের শূন্যদৃষ্টি নিয়ে রিরার দিকে তাকিয়ে রইল। সেই দৃষ্টি দেখে সম্পূর্ণ অকারণে হঠাৎ রিরা আরো ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। সে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি ঝকিয়ে চিৎকার করে বলল, আমি যে তোমাকে গুলি করে মেরে না ফেলে এখনো বেঁচে থাকার জন্য দুবেলা খাবার দিচ্ছি, সেটা তোমার চৌদ্দপুরুষের ভাগ্য। এই ভাগ্যকে টেনে আর লম্বা করার চেষ্টা করো না বুঝেছ?
নীলমানবটি কী বুঝল কে জানে, কিন্তু সে সম্মতিসূচকভাবে মাথা নেড়ে রিরার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
রিরা ক্যাপ্টেনের ঘরে দীর্ঘসময় একা একা খাবারের ট্রে নিয়ে বসে থাকে। নিঃসঙ্গ এই মহাকাশযানটি আর কয়েকদিনের মাঝে ধ্বংস হয়ে যাবে, জীবনের এই শেষ কয়েকটি মুহূর্তে তার কোনো একজন আপনজনের সাথে কথা বলার জন্য বুকের ভেতরটি হাহাকার করতে থাকে। এখানে কোনো আপনজন নেই, একমাত্র জীবিত প্রাণী নীলমানবটির কথা তার ঘুরেফিরে মনে হতে থাকে। গুলিবিদ্ধ অসহায় প্রাণীটির শূন্যদৃষ্টির কথাটি সে ভুলতে পারে না। তার মনে হয় সে খাবারের ট্রেটি নিয়ে নীলমানবের কাছে যাবে, গিয়ে বলবে, আমি দুঃখিত যে তোমার সাথে এত দুর্ব্যবহার করেছি। এস জীবনের শেষ কয়েকটা মুহূর্ত আমরা ভুলে যাই তুমি নীলমানব এবং আমি মানুষ। দুজনে একসাথে বসে বসে খেতে খেতে কথা বলি।
কিন্তু রিরা নীলমানবের কাছে গেল না, ক্যাপ্টেনের সুদৃশ্য ঘরে একা একা খাবারের ট্রে সামনে নিয়ে বসে রইল।
০৫. রিরা মনিটরের সামনে
রিরা মনিটরের সামনে নিঃশব্দে বসে আছে। মহাকাশযানটি একটা নিউট্রন স্টারের গা ঘেঁষে যেতে যেতে গতি সঞ্চয় করছে—দূরে একটা গ্রহাণুপুঞ্জ, তার ভেতর দিয়ে যাবার কথা। রিরা গ্রহাণুপুঞ্জটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে মহাকাশযানের মূল প্রসেসরকে জিজ্ঞেস করল, এই গ্রহাণুপুঞ্জের সব গ্রহ-উপগ্রহ কি নিখুঁতভাবে ক্যাটালগ করা আছে?
আছে। এটা আমাদের নিয়মিত রুটের মাঝে পড়ে।
তা হলে আমরা এখানকার ভালো দেখে একটা গ্রহে নেমে পড়ি না কেন?
মহাকাশযানের মূল প্রসেসর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, এটি একটি অত্যন্ত অবাস্তব পরিকল্পনা।
রিরা একটু রেগে উঠে বলল, কেন? অবাস্তব পরিকল্পনা কেন?
এই মহাকাশযানটি খুব খারাপভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে—কোনো গ্রহে নামা বা সেখান থেকে ওঠার ক্ষমতা নেই। নামতে গেলে বিধ্বস্ত হবার আশঙ্কা শতকরা নব্বই ভাগ থেকে বেশি।
রিরা কাঠকাঠ স্বরে হেসে উঠে বলল, মহাকাশে যেতে থাকলে এমনিতেই মহাকাশযান বিধ্বস্ত হয়ে যাবে—তা হলে নামার চেষ্টা করে বিধ্বস্ত হওয়া কি বুদ্ধিমানের কাজ না? যদি বেঁচে যাই, তা হলে কী লাভ হবে বুঝতে পারছ?
না, বুঝতে পারছি না।
তা হলে হয়তো ভবিষ্যতে কখনো কোনো মহাকাশযান এসে আমাদের উদ্ধার করতে পারবে।
তার সম্ভাবনা দশমিক শূন্য শূন্য চার ভাগ।
রিরা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, তুমি তোমার সম্ভাবনা হিসাব করে বের করা একটু বন্ধ করবে?
আমি দুঃখিত রিরা। মূল প্রসেসর তার শুক ধাতবস্বরে বলল, আমি তোমাকে সিদ্ধান্ত নেবার ব্যাপারে সাহায্য করছিলাম।
তোমার যেখানে সাহায্য করার কথা, সেখানে সাহায্য করলেই হবে। সিদ্ধান্ত নেবার ব্যাপারে সাহায্য করতে হবে না।
ঠিক আছে।
এখন ক্যাটালগ দেখে আমাকে জানাও কোন গ্ৰহটাতে নামা সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
মহাকাশযানের মূল প্রসেসর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি সবগুলো গ্রহ পরীক্ষা করে দেখলাম। এর কোনোটাই দীর্ঘ সময় থাকার উপযোগী নয়।
রিরা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তোমাকে খুব সহজ একটা জিনিল বোঝানো যাচ্ছে! আমি আমার গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে এই গ্রহে যাচ্ছি না। আমি এই গ্রহে যাচ্ছি কোনো উপায় না দেখে হয়তো এই গ্রহে কিছুদিন থাকা যাবে—যে সময়ের ভেতরে কোনো উদ্ধারকারী মহাকাশযান আমাদের খুঁজতে আসবে। বুঝেছ?
বুঝেছি।
তা হলে আমাকে বলে কোন গ্রহটা সবচেয়ে কম বিপজ্জনক।
মহাকাশযানের মূল প্রসেসর বলল, প্রথম প্রহটা ছোট–বায়ুমণ্ডল নেই, প্রতিমুহূর্তে উল্কাপাত হচ্ছে–খুব বিপজ্জনক। দ্বিতীয় গ্রহটা এখনো শীতল হয় নি, অসংখ্য আগ্নেয়গিরি ক্রমাগত লাভা বের হচ্ছে, এটাও বিপজ্জনক। তৃতীয় গ্ৰহটাতে একটা বায়ুমণ্ডল আছে, তাপমাত্রাও মোটামুটি আরামদায়ক–তবে গ্রহটা পুরোপুরি অন্ধকার।
রিরা মাথা নেড়ে বলল, উহুঁ, অন্ধকার গ্রহে যাওয়া যাবে না। মহাকাশযানের প্রসেসর বলল, চতুর্থ গ্রহটাকে মনে করা যায় বাসযোগ্য, অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি এর মাধ্যাকর্ষণজনিত ত্বরণ জি-এর কাছাকাছি। গ্রহটি মোটামুটি আলোকিত, একটা কাজ চালানোর মতো বায়ুমণ্ডল আছে, তবে অক্সিজেন সাপ্লাই না নিয়ে তুমি বের হতে পারবে লা।
রিরা টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, চমৎকার!
আগেই চমৎকার বলো না। মানুষ প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে এখানে কলোনি করেছিল, কিন্তু–