মূল ভাবনাটা অনুমান করতে পারছি।
রিরা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, সেটাই যথেষ্ট।
মহাকাশযানের মূল প্রসেসর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, তুমি তা হলে কীভাবে ফুটোগুলো বন্ধ করবে?
অত্যন্ত প্রাচীন পদ্ধতি ব্যবহার করে।
কোন প্রাচীন পদ্ধতি?
ওয়েল্ডিং। ধাতব পাত এনে উপরে লাগিয়ে ওয়েন্ড করব। বাতাস বের হয়ে যাওয়া কমবে।
এটি অত্যন্ত শ্রমসাপেক্ষ ব্যাপার।
রিরা বলল, জানি। তোমার কি এর চাইতে ভালো কোনো পদ্ধতি জানা আছে?
না, জানা নেই। তবে—
তবে কী?
এরকম পরিশ্রমসাপেক্ষ একটি কাজ করে ঠিক কী লাভ হবে? মহাকাশযানটি দুদিন পরে ধ্বংস না হয়ে হয়তো তিন কিংবা চার দিন পরে ধ্বংস হবে। মহাকাশযানটিকে তো রক্ষা করা যাবে না।
রিরা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, মানুষের সাথে এখানে যন্ত্রের পার্থক্য। মানুষ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করে। যন্ত্র করে না।
কিন্তু যেখানে আশা নেই, সেখানে চেষ্টা করে কী লাভ?
আমি সেটা তোমাকে বুঝাতে পারব না। মানুষের ইতিহাস পড়ে দেখ, অসংখ্যবার তারা অসাধ্য সাধন করছে। তবে রিরা একমুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, আমার অসাধ্য সাধন করার ক্ষমতা নেই, কিন্তু শুধুমাত্র বসে বসে তো আর মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে পারি না। কিছু একটা করে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চাই।
মহাকাশযানের মূল প্রসেসর শুষ্ক কণ্ঠে বলল, তুমি কি নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য এখনই ওয়েল্ডিং করতে শুরু করে দেবে?
হ্যাঁ। ওয়েল্ডিঙের যন্ত্রপাতি কোথায় আছে বলে দাও। এই কাজে সাহায্য করার জন্য কি কোনো নিম্নশ্রেণীর রোবট পাওয়া যাবে?
আমি খুব দুঃখিত রিরা। এটি এত প্রাচীন পদ্ধতি যে, কোনো রোবটকে এটা শেখানো হয় না।
রিরা টানা ছয় ঘণ্টা কাজ করে কন্ট্রোলরুমের আশপাশের দেয়ালগুলোর ফুটোগুলো ওয়েল্ডিং করে বন্ধ করার চেষ্টা করল। পুরোপুরি নিচ্ছিদ্র করতে পারল না, কিন্তু যেটুকু করেছে সেটা খারাপ নয়, বাতাস আগে থেকে অনেক কম বের হবে, মহাকাশযানটি। পুরোপুরি বায়ুশূন্য হতে এখন নিশ্চিতভাবে আরো দুদিন বাড়তি সময় পাওয়া যাবে। রিরা মনে মনে আশা করে আছে কোনো একটি উদ্ধারকারী মহাকাশযান তাদেরকে উদ্ধার করতে আসবে—সেজন্য মহাকাশযানটি যত দীর্ঘ সময় বাচিয়ে রাখতে পারবে, ততই বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। যদিও সে খুব ভালো করে জানে সুবিস্তৃত এই বিশাল মহাশূন্যে তাদেরকে উদ্ধার করতে যে সময়ের প্রয়োজন, সেই সময়টুকু তারা কোনোভাবেই মহাকাশযানটাকে টিকিয়ে রাখতে পারবে না। কিন্তু কখনো কখনো তো অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে—তার জীবনেও কি একটা অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটতে পারে না?
ক্যাপ্টেনের ঘরে গিয়ে খেতে বসে তার হঠাৎ করে নীলমানবের কথা মনে পড়ল। নীলমানবটি কি এখনো বেঁচে আছে? রিরা কী ভেবে খাবারের ট্রেটা সরিয়ে রেখে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা কাঁধে ঝুলিয়ে কার্গো বের পাশে করিডরের কাছে তালাবদ্ধ ঘরটির সামনে এসে দাঁড়াল। অস্ত্রটি উদ্যত রেখে সে সাবধানে তালা খুলে দরজাটা ঠেলে ভেতরে উঁকি দিল, নীলমানবটি মারা যায় নি, দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। রিরার মনে হল তাকে দেখে তার মুখে খুব সূক্ষ্ম একটি হাসি ফুটে উঠল। নীলমানবটি পায়ের কাছে ট্রাউজারটি গুটিয়ে এনেছে, রক্ত বন্ধ করার জন্য শরীরের কাপড় ছিঁড়ে শক্ত করে বেঁধে রেখেছে। আগে শরীরের নানা জায়গায় শুকিয়ে যাওয়া কালো রক্তের দাগ ছিল, মনে হল পানি দিয়ে সে সেগুলো ধুয়ে পরিষ্কার করেছে।
নীলমানবটি কোনো কথা না বলে এক ধরনের কৌতূহল নিয়ে রিরার দিকে তাকিয়ে রইল। রক্তক্ষরণে মারা যাবে বলে রিরার যে ধারণাটি ছিল সেটি সত্যি হবার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না—ব্যাপারটিতে রিরার রেগে ওঠার কথা ছিল কিন্তু খানিকটা বিস্ময় নিয়ে সে আবিষ্কার করল, সে মোটেও রেগে উঠছে না, বরং নীলমানবটি বেঁচে আছে দেখে সে এক ধরনের স্বস্তিবোধ করছে। যে নৃশংস প্রাণীরা তার মহাকাশযানের সবাইকে হত্যা। করেছে, তাদের একজন এখনো বেঁচে আছে বলে সে স্বস্তিবোধ করছে দেখে রিরা নিজের ওপর রেগে ওঠে। সে জোর করে মুখে এক ধরনের কাঠিন্য নিয়ে এসে নীলমানবটির দিকে তাকিয়ে থাকে।
নীলমানবটি রিরার দিকে তাকিয়ে বলল ওয়েল্ডিং।
তার সারা শরীরে কালিঝুলি মাখানো, ওয়েল্ডিঙের এসিডের ঝাঁজালো গন্ধ শরীর থেকে বের হচ্ছে, সে যে ওয়েল্ডিং করে এসেছে সেটা বোঝা খুব কঠিন নয়। নীলমানবটির কথার উত্তরে সে মাথা নাড়ল।
নীলমানবটি নিজের বুকে থাবা দিয়ে বলল, আমি ওয়েল্ডিং ভালো। অনেক ভালো।
রিরা ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি খুব ভালো ওয়েল্ডিং করতে পার?
নীলমানবটি হ্য-সূচকভাবে মাথা নাড়ল। রিরা মাথা নাড়ল, বলল, তাতে কিছু আসে যায় না। তুমি আশা করবো না আমি তোমাকে এখানে ওয়েল্ডিং করতে দেব। বুঝেছ?
নীলমানবটি মাথা নেড়ে আবার বলল, আমি খুব ভালো ওয়েল্ডিং। বেশি বেশি ভালো ওয়েন্ডিং।
ব্যস, অনেক হয়েছে। নিজের প্রশংসায় এত পঞ্চমুখ হবার কোনো দরকার নেই। রিরা একটু থেমে বলল, তোমার পায়ে যে গুলি লেগেছে, সেটা খেয়াল আছে? গুলি-লাগা পা দিয়ে তুমি দাঁড়াবে কেমন করে শুনি?
রিরার সব কথা নীলমানব বুঝতে পারল না কিন্তু তার কথায় যে তার গুলি খাওয়া পায়ের কথা আছে সেটা সে বুঝতে পারল। নীলমানব তার পায়ের দিকে দেখিয়ে বলল, কিজুন।
কিজুন?