রিরা আবার ক্রুদ্ধ গলায় বলল, চুপ কর শয়তানের বাচ্চা। আমি আমার জীবনের শেষ সময়টা তোমার মতো দানবদের সেবা-যত্ন করে কাটাতে পারব না। তোমার গুলি খেয়ে মরার কথা ছিল—-তোমার চৌদ্দপুরুষের সৌভাগ্য যে গুলি খেয়ে মরতে হচ্ছে না। সভ্য মানুষের মতো রক্তক্ষরণে মারা যাচ্ছ। বুঝেছ?
নীলমানবটি আবার ধৈর্য ধরে রিরার কথা শুনে গেল। তার কথা শেষ হবার পর বলল, পানি। কিশিমারা।
কিশিমারা? রিরা ধমক দিয়ে বলল, কিশিমারা মানে কী? তিতির পাখির ঝলসানো কাবাব? নাকি আঙুরের রস? গ্যালাক্সির মহাসম্রাটের আর কী কী প্রয়োজন? ঘুমানোর জন্য নরম বিছানা? নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রার সুগন্ধি বাতাস? স্নায়ু-উত্তেজক কিছু পানীয়?
নীলমানবটি মাথা নাড়ল, এবং রিরার প্রথমবার মনে হল তার মুখে খুব সূক্ষ্ম এক ধরনের হাসি ফুটে উঠেছে। নীলমানবেরা যে মানুষের একটি অপভ্রংশ এই প্রথমবার রিরার মাথায় উঁকি দিয়ে যায়। রিরা জিজ্ঞেস করল, তা হলে কিশিমারা মানে কী?
কিশিমারা। নীলমানবটি মুখে একটি কাতর ভঙ্গি করে হাত দুটি বুকের কাছে এনে অনুনয়ের ভঙ্গি করে।
ও! রিরার রাগ কমে আসে, তা হলে কিশিমারা মানে অনুগ্রহ করে?
নীলমানবটি মাথা নাড়ল, কিশিমারা অনুগ্রহ… কিশিমারা… অনুগ্রহ পানি পানি অনুগ্রহ।
ঠিক আছে। রিরা তার অস্ত্রটা হাতবদল করে বলল, তোমাকে এক বোতল পানি দিচ্ছি কিন্তু আর কিছু পাবে না। এই বোতল পানি খেয়ে ঝটপট তোমাকে মরে যেতে হবে। বুঝেছ? আমি তোমার সেবা করতে পারব না।
নীলমানবটি মাথা নাড়ল, বলল, বুঝেছি। বুকে হাত দিয়ে নিজেকে দেখিয়ে বলল, বুঝেছি।
রিরা পানির একটি বোতলের সাথে কী মনে করে দুই টুকরো রুটি, এক টুকরো কৃত্রিম প্রোটিন আর একটা শুকনো ফল নিয়ে এল। ট্রেটা নীলমানবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, খাও। এবং মনে রেখ এটা হবে তোমার প্রথম এবং শেষ খাবার।
নীলমানবটির মুখের মাংসপেশি হঠাৎ শিথিল হয়ে সেখানে একটি হাসি ফুটে ওঠে। রিরা প্রথমবার লক্ষ করল, নীলমানবটির বয়স খুব বেশি নয় এবং গায়ের রঙ নীল না হলে এবং চোখ দুটোতে এত অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি না থাকলে তাকে সুদর্শন মানুষ হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যেত। নীলমানবটি খাবার ট্রেটা নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলল, কুগুরা।
কুগুরা? রিরা কঠিন মুখে বলল, কুগুরা মানে কী? আরো চাই?
নীলমানবটি খাবারটুকু দুই ভাগ করে এক ভাগ নিজের কাছে রেখে অন্য ভাগ রিরার দিকে এগিয়ে দিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, কুগুরা।
রিরার কয়েক মুহূর্ত লাগল বুঝতে যে নীলমানবটি তার খাবারের অর্ধেক তাকে খেতে দিয়েছে। যখন বুঝতে পারল তখন হঠাৎ সে শব্দ করে হেসে ফেলল, হাসতে হাসতে বলল, এমনিতে মহাকাশযানের সব মানুষকে গুলি করে মেরে ফেল, কিন্তু খাবার বেলায় সেটা ভাগাভাগি করে খাও! এটা তোমাদের কোন ধরনের ভদ্রতা?
নীলমানবটি কোনো কথা না বলে বোতলটি মুখে লাগিয়ে ঢকঢক করে অনেকখানি পানি খেয়ে রিরার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, কুগুরা। অনেক কুগুরা।
কুগুরা মানে কি ধন্যবাদ?
হ্যাঁ। নীলমানবের মুখে আবার একটু হাসির চিহ্ন দেখা গেল, মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, ধন্যবাদ। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।
রিরা অর্ধেক করে তার কাছে পাঠানো খাবারের ট্রেটা ধাক্কা দিয়ে নীলমানবের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দিয়ে বলল, কুগুরা। ধন্যবাদ। আমি খেয়ে এসেছি—এটা তোমার জন্য।
তারপর দরজাটা টেনে বন্ধ করতে করতে বলল, আবার যখন আলব, তখন যেন ঝামেলা না থাকে। খাবারটা খেয়ে ঝটপট মরে যাও। মনে থাকবে?
নীলমানবটি দুই টুকরো রুটির মাঝে প্রোটিনের টুকরোটা রেখে সেটিতে একটা বড় কামড় দিয়ে বলল, ধন্যবাদ। তোমাকে ধন্যবাদ। অনেক ধন্যবাদ।
০৪. কন্ট্রোল প্যানেলে ঝুঁকে পড়ে
কন্ট্রোল প্যানেলে ঝুঁকে পড়ে রিরা বলল, আমাদের মহাকাশযানের এখন কী অবস্থা?
মহাকাশযানে মূল প্রসেসর শুষ্ক কণ্ঠে উত্তর দিল, অবস্থা ভালো নয়। গত আঠার ঘণ্টায়। আরো কিছু জ্বালানি ক্ষয় হয়েছে। কক্ষপথের পরিবর্তন না করলে আমরা অতিকায় অন্ধকার গ্রহটার মহাকর্ষ বলে আটকা পড়ে যাব।
তা হলে কক্ষপথ পরিবর্তন করছি না কেন?
দুটি কারণে। মহাকাশযানের ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং যথেষ্ট জ্বালানি নেই। জ্বালানি পরিবহন টিউব ফেটে গিয়ে অনেক জ্বালানি নষ্ট হয়েছে।
রিরা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, মহাকাশযানের বাতাসের কী খবর?
খুব দ্রুত বাতাস বের হয়ে যাচ্ছে। আমরা রিজার্ভের বাতাস ব্যবহার করতে শুরু করেছি।
রিরা চিন্তিত মুখে বলল, এটা খুব খারাপ খবর।
হ্যাঁ। মূল প্রসেসর শুষ্ক কণ্ঠে বলল, রিজার্ভের বাতাস ব্যবহার করা খুব বিপজ্জনক।
রিরা টেবিলে শব্দ করতে করতে বলল, কিছু বাতাস রক্ষা করা যাক। কী বলো?
কীভাবে?
মহাকাশযানে আমি ছাড়া আর কোনো জীবিত প্রাণী নেই। আমার তো খুব বেশি জায়গার প্রয়োজন নেই। কাজেই অল্পকিছু জায়গা বায়ু নিরোধক করে ফেল।
তাতেও সমস্যার সমাধান হবে না। কেন?
গোলাগুলিতে দেয়ালে অনেক ফুটো হয়েছে।
ফুটোগুলো বন্ধ করা যাক।
মহাকাশযানের ফুটো বন্ধ করার কোনো ক্ষমতা আমার নেই।
আমি জানি মহাকাশযানে ফুটো বন্ধ করার তোমার কোনো ক্ষমতা নেই। তুমি হচ্ছ তথ্যকেন্দ্র। তোমার তথ্যগুলো খুব প্রয়োজনীয় যখন সবকিছু ঠিকভাবে কাজ করে। যখন। বড় কোনো বিপদ হয়, তখন মানুষকে নিজের চেষ্টায় বেঁচে থাকতে হয়। বুঝেছ?