লিশান খুব ধীরে ধীরে তার চেয়ারটাতে বসে বললেন, আমি ভেবেছিলাম তুমি সত্যি বুঝি আমার মেয়ে।
য়িমা এক ধরনের বিষণ্ণ চোখে বলল আমি সত্যি তোমার মেয়ে বাবা, তারা তোমার সাথে কথা বলার জন্যে আমাকে বেছে নিয়েছে।
লিশান য়িমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি কি সত্যিই য়িমা?
আমি সত্যিই য়িমা কিন্তু আমি এখন আরো অনেক কিছু।
আরো অনেক কিছু কী?
য়িমা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তুমি সেটা বুঝবে না বাবা। তুমি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতবিদ কিন্তু তবু তুমি বুঝবে না। ত্রিমাত্রিক জগতের মানুষ দশটি ভিন্ন মাত্রাকে একসাথে অনুভব করতে পারে না।
তুমি পার?
এখন পারি। কেউ যদি দীর্ঘদিন অন্ধকার একটা ঘরে ছোট একটা আলো নিয়ে বেঁচে থাকে তারপর হঠাৎ যদি সে আলোকোজ্জ্বল পৃথিবীতে বের হয়ে আসে, তখন তার যেরকম লাগে আমার সেরকম লাগছে।
সত্যি?
হ্যা বাবা। মানুষের যেরকম দুঃখ কষ্ট রাগ ভালবাসার অনুভূতি আছে আমার সে অনুভূতি আছে, তার সাথে সাথে আরো অসংখ্য নতুন অনুভূতির জন্ম হয়েছে–তোমরা যেগুলো কখনো অনুভব কর নি, কখনো অনুভব করতে পারবে না।
লিশান আস্তে আস্তে বললেন, য়িমা, তোমাকে আমি বুকে ধরে মানুষ করেছি। তুমি যখন ছোট ছিলে তখন কত রাত আমি তোমাকে বুকে চেপে এ–ঘর ও–ঘর ঘুরে বেড়িয়েছি। তখন আমি তোমার জন্যে বুকে এক তীব্র ভালবাসা অনুভব করেছি। যে প্রাণী মানুষের বুকে সেই তীব্র ভালবাসার জন্ম দিতে পারে সেই প্রাণী নিশ্চয়ই খুব আশ্চর্য উন্নত এক প্রাণী।
হ্যাঁ বাবা। সেই প্রাণী খুব উন্নত প্রাণী।
য়িমা হেঁটে এসে লিশানের হাত স্পর্শ করে বলল, আমি তোমাকে খুব ভালবাসি বাবা।
আমি জানি।
তুমি জান না বাবা, তুমি কখনো জানবে না।
লিশান চুপ করে রইলেন তারপর নরম গলায় বললেন, আমি যে সমাধানটি বের করেছি সেটা পৃথিবীর মানুষ কখনো জানতে পারবে না?
না! তুমি যখন নেটওয়ার্কে দিয়েছ সাথে সাথে সেটি সরিয়ে নেয়া হয়েছে। পৃথিবীর মানুষ কখনো সেটা জানবে না।
তোমরা চাও না মানুষ সেটা জানুক?
না। আমরা চাই না। মানুষ আমাদের সবচেয়ে প্রিয় সৃষ্টি। এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সিতে আমরা একটা প্রাণ সৃষ্টি করেছি সেটিও চমৎকার একটি প্রাণ কিন্তু তোমাদের মতো এত সুন্দর নয়। ক্যাসিওপিয়ার কাছাকাছি একটা প্রাণ তৈরি করেছি সেটা সমন্বিত প্রাণ, বিশাল একটি একক, তোমাদের কাছে সেটা মনে হবে বিচিত্র!
তুমি কেন আমাকে এসব বলছ?
তোমার জানার এত আগ্রহ সেজন্যে। তুমি যদি চাও তোমাকে আমরা অন্য কোথাও নিয়ে যেতে পারি। অন্য কোনো জগতে
না। লিশান মাথা নাড়লেন, আমাকে এখানেই রেখে দিয়ে যাও। পৃথিবীর উপর মায়া পড়ে গেছে। আমি এখানেই মারা যেতে চাই।
লিশান খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, য়িমা—
বল বাবা।
তোমরা তো এখন আমাকে মেরে ফেলবে। আমি কি মারা যাবার আগে তোমাদের একবার দেখতে পারি?
এই তো আমাকে দেখছ–
না মানুষের রূপে না, সত্যিকার রূপে।
তোমার দেখার ক্ষমতা নেই বাবা! আমরা মানুষকে তৃতীয় মাত্রার বাইরে দেখার ক্ষমতা দেই নি।
আমি তবু দেখতে চাই।
তুমি ভয় পাবে বাবা।
তবু দেখতে চাই
ঠিক আছে, এস, দেখবে এস। হাত বাড়িয়ে দাও।
লিশান তার হাত বাড়িয়ে দিলেন, সেটি অল্প অল্প কাঁপছিল।
.
বিশাল এক আদিগন্ত বিস্তৃত শূন্যতা, সেই শূন্যতার কোনো শুরু নেই, কোনো শেষ নেই, কোনো আদি নেই, কোনো অন্ত নেই। বিশাল সেই শূন্যতা কুণ্ডলী পাকিয়ে অন্ধকার অতল গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে, পাক খেয়ে খেয়ে বিলীন হয়ে যাচ্ছে এক ভয়ঙ্কর আকর্ষণে। চারদিকে বিচিত্র এক নৈঃশব্দ্য, সেই নৈঃশব্দ্যে অন্য এক নৈঃশব্দ্য হঠাৎ করে তীব্র ঝলকানি দিয়ে ওঠে, সমস্ত চেতনা হঠাৎ এক ভয়ানক প্রলয়ের জন্যে উন্মুখ হয়ে ওঠে, সমস্ত স্নায়ু হঠাৎ টান টান হয়ে অপেক্ষা করে ধ্বংসের জন্যে…
.
পরদিন পৃথিবীর নেটওয়ার্কে বড় করে প্রচারিত হল সর্বকালের শ্রেষ্ঠ গণিতবিদ লিশানের মৃত্যুর খবর। মৃত্যুর আগে ছোট দুর্ঘটনায় তার যোগাযোগ মডিউল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তিনি কিসের উপর গবেষণা করছিলেন সেটা কেউ জানতে পারল না।
লিশানের মৃত্যুতে তার মেয়ে য়িমার প্রতিক্রিয়া জানার জন্যে কিছু সাংবাদিক তাকে খোঁজ করছিল। নেটওয়ার্ক জানিয়েছে এই খবর প্রচারিত হওয়া পর্যন্ত সময়ে তাকে তখনো পাওয়া যায় নি।
জগলুল সিংগুলারিটি
রিলেটিভিটির ক্লাসে প্রফেসর জগলুল হঠাৎ লক্ষ করলেন তৃতীয় বেঞ্চের মাঝামাঝি জায়গায় বসে আলাউদ্দিন গালে হাত দিয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে। দেখে প্রফেসর জগলুলের একটু মেজাজ খারাপ হল। তিনি ডাকসাইটে প্রফেসর, তার ক্লাসে ছাত্ররা অমনোযোগী হবে–সে যত ভালো ছাত্রই হোক তিনি সেটা সহ্য করতে পারেন না।
ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা থামিয়ে তিনি একটু এগিয়ে গিয়ে থমথমে গলায় ডাকলেন, আলাউদ্দিন–
আলাউদ্দিন সাথে সাথে ছাদ থেকে চোখ নামিয়ে আনে, জি স্যার?
তুমি ছাদের দিকে তাকিয়ে আছ কেন?
একটা জিনিস ভাবছিলাম।
ক্লাসে তুমি অন্য জিনিস ভাবতে আস নি, ক্লাসে এসেছ আমি কী পড়াচ্ছি সেটা শুনতে।
আমি সেটাও শুনছি স্যার। শুনতে শুনতে ভাবছি।
তুমি আমার পড়া শুনছ?
জি স্যার শুনছি।
প্রফেসর জগলুল এবারে সত্যি সত্যি রেগে গেলেন; কেউ মিথ্যে কথা বললে তিনি ভীষণ রেগে যান। চোখ লাল করে ছোট একটা গর্জন করে বললেন, তুমি আমার কথা শুনছ?