দেখিয়েছি।
তুমি এককোষী প্রাণীর ফসিলের ডি. এন. এ. থেকে দেখিয়েছ তাতে যে–ধরনের সামঞ্জস্য আছে সেই সামঞ্জস্যের জন্যে প্রয়োজনীয় স্থিতিশীলতা পৃথিবীর পরিবেশে ছিল না। দেখাও নি?
হ্যাঁ, আমি দেখিয়েছি।
তুমি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতবিদ। তুমি কোনো ভুল কর নি লিশান।
লিশান একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, যা আমি জানি, আমি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছি পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টি হতে পারে না। কিন্তু পৃথিবীতে শুধু যে প্রাণ রয়েছে তাই নয়, এখানে রয়েছে পরিচিত জগতের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী। তারা কোথা থেকে এল?
লিশানের মতো দেখতে প্রতিচ্ছবিটি নরম গলায় বলল, তুমি জান তারা কোথা থেকে এসেছে।
লিশান মৃদু গলায় বললেন, হ্যাঁ, আমি জানি। আর জানি বলেই আমার ভিতরে কোনো শান্তি নেই।
তুমি ভয় পাচ্ছ লিশান?
হা, বলতে পার এক ধরনের ভয়।
প্রতিচ্ছবিটি হেসে বলল, তোমার তো ভয় পাবার কিছু নেই লিশান। ভয় পাচ্ছ কেন?
আমি যে সমাধানটি করেছি সেটি কোথাও প্রকাশ করি নি। পৃথিবীর কেউ সেটা এখনো জানে না। যখন জানবে তখন কী একটা আঘাত পাবে পৃথিবীর মানুষ! এই পৃথিবীতে তাদের থাকার কথা নয়। তারা আছে কারণ এক বুদ্ধিমান প্রাণী তাদের এই পৃথিবীতে এনেছে! চিন্তা করতে পার?
তুমি ঠিকই বলেছ। ব্যাপারটি বিশ্বাস করা কঠিন, গ্রহণ করা আরো কঠিন।
হ্যাঁ। আর পুরো ব্যাপারটি চিন্তা করলে গায়ে কেমন যেন কাঁটা দিয়ে ওঠে।
কেন লিশান?
যে বুদ্ধিমান প্রাণী পৃথিবীতে মানুষের, জীবজন্তু, গাছপালা, কীটপতঙ্গের জন্ম দিয়েছে তারা যদি আমাদের সাথেই আছে, তারা যদি আমাদের তীক্ষ্ণ চোখে পরীক্ষা করছে, তাদের কাছে যদি পুরো ব্যাপারটা হয় পরীক্ষাগারে একটা গবেষণা? একটা কৌতুক?
তাহলে কী হবে?
তারা যদি আমাদের এখন দেখা দেয়? তারা যদি মনে করে কৌতুকের অবসান হয়েছে, এখন পৃথিবীতে আর প্রাণের প্রয়োজন নেই?
লিশানের প্রতিচ্ছবিটি শব্দ করে হেসে বলল, তুমি মনে হয় পুরো ব্যাপারটি নিয়ে একটু বেশি উত্তেজিত হয়ে আছ! তোমার মস্তিষ্ক মনে হয় খানিকটা উত্তপ্ত। তোমার এই সমস্যাটি প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে সমস্ত পৃথিবী ধোঁয়া হয়ে মিলিয়ে যাবে, তুমি সেটা সত্যি বিশ্বাস কর?
লিশান কোনো কথা না বলে শূন্য দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে রইল।
.
ভোরবেলা লিশান খাবার টেবিলে বসে খানিকটা ফলের রস খেল দীর্ঘ সময় নিয়ে। তারপর যোগাযোগ কেন্দ্রে সাজিয়ে রাখা পুরো সমাধানটির ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে সেটি কেন্দ্রীয় নেটওয়ার্কে প্রবেশ করিয়ে দিল। কয়েক মুহূর্তে সেটি এখন পৃথিবীর সব গবেষণাগারে, সব শিক্ষাকেন্দ্রে, সব প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে যাবে। পৃথিবীর মানুষ কিছুক্ষণের মধ্যেই জেনে যাবে এই পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল না। এখানে প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে। কারণ কোনো একটি বুদ্ধিমান প্রাণী এখানে প্রাণ সৃষ্টি করতে এসেছে। মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব নয়। মানুষ কোনো একটি প্রাণীর হাতের পুতুল, গবেষণাগারের একটি পরীক্ষা, খেয়ালি একজনের কৌতুক।
লিশান দুপুরবেলা ঘর থেকে বের হলেন। তার বাসার কাছে একটা ছোট হ্রদ রয়েছে, হ্রদের চারপাশে পাইনগাছ। হ্রদের টলটলে নীল পানিতে উত্তরের হিমশীতল দেশ থেকে উড়ে এসেছে কিছু বুনোহাঁস। তারা সেখানে পানি ছিটিয়ে খেলা করে। লিশান পকেটে করে তাদের জন্যে কিছু খাবার নিয়ে এসে রোজ হ্রদের তীরে বসে বসে তাদের খাওয়ান। হাঁসগুলো ঝাপাঝাপি করে খায়, পানি ঝাঁপটিয়ে ছুটে বেড়ায়, তার দেখতে বড় ভালো লাগে। এই হাঁসগুলোও ঠিক মানুষের মতোই কোনো এক বুদ্ধিমান প্রাণীর তৈরী কিন্তু তাদের দেখলে লিশান কিছুক্ষণের জন্যে সেটা ভুলে যেতে পারেন।
লিশান অপরাহ্নে ঘরে ফিরে এলেন। ফিরে আসতে তার খুব দ্বিধা হচ্ছিল। তিনি জানেন তার বাসাকে ঘিরে থাকবে অসংখ্য সাংবাদিক, নেটওয়ার্কের ক্যামেরা। বছর দশেক আগে তিনি ছোট একটি সূত্র প্রমাণ করেছিলেন, তখন সেটা নিয়েই অনেক হইচই হয়েছিল। তার তুলনায় এটা অনেক বড় ব্যাপার, এবারে কী হবে কে জানে।
ঘরের কাছাকাছি পৌঁছে লিশান কিন্তু খুব অবাক হলেন, তার ঘরের আশপাশে কেউ নেই। হঠাৎ কেন জানি তার বুক কেঁপে উঠল। কিছু একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার ঘটেছে এখানে। তিনি কয়েক মুহূর্ত বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে দরজা স্পর্শ করে ভিতরে ঢুকলেন। ঘরের মাঝামাঝি তার মেয়ে য়িমা দাঁড়িয়ে আছে। লিশান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন তারপর কোমল গলায় বললেন, তুমি সত্যি এসেছ?
হ্যা বাবা। য়িমা কাছে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এই যে, আমাকে ছুঁয়ে দেখ।
লিশান হাত বাড়াতে গিয়ে লক্ষ করলেন তার হাত অল্প অল্প কাঁপছে। য়িমা লিশানের হাতটা ধরে বলল, তোমার শরীর ভালো আছে তো বাবা?
লিশান এক ধরনের শূন্য দৃষ্টিতে য়িমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর মৃদু গলায় বললেন, ভালো আছি মা
তুমি কি আমাকে দেখে অবাক হয়েছ বাবা?
লিশান মাথা নাড়লেন, না, অবাক হই নি। খুব কষ্ট হচ্ছে, বুকটা ভেঙে যাচ্ছে, কিন্তু অবাক হই নি। আমি বুঝতে পেরেছিলাম তাদের কেউ আসবে, কিন্তু কে হবে সেই মানুষটি বুঝতে পারি নি। কখনো ভাবি নি সেটা হবে তুমি।