এই যে এলাম—
লিশান তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, এটা তো আসা হল না।
য়িমা একটু আহত গলায় বলল, ঠিক আছে বাবা, আমি আর এভাবেও আসব না।
আসবে না কেন মা, আসবে। অবশ্যি আসবে। বাবার ওপর রাগ করতে হয় না, বিশেষ করে যদি বোকা বাবা হয়।
য়িমা একটু হেসে ফেলে আরেকটু এগিয়ে বলল, বাবা তুমি এখন কী নিয়ে কাজ করছ?
জটিল একটা অঙ্ক করছি।
মানুষ আজকাল নিজে নিজে অঙ্ক করে না বাবা! অঙ্ক করার জন্যে কত ক্রাঞ্চ মেশিন তৈরি হয়েছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা মেশিন আছে তার নাম অলৌকিক চিন্তাবিদ। তুমি দেখলে অবাক হয়ে যাবে বাবা, সেটা যে কত তাড়াতাড়ি কত কঠিন কঠিন অঙ্ক করে ফেলে!
তাই নাকি?
হ্যা বাবা। তুমি কোনোকিছু খোঁজ রাখ না। তোমার অঙ্কটা সেরকম একটা মেশিনকে কেন দিলে না?
তাহলে আমি কী করব?
অন্য সবাই যা করে তুমিও তাই করবে। পাহাড়ে বেড়াতে যাবে, সমুদ্রে যাবে, জাদুঘরে যাবে, সঙ্গীতানুষ্ঠানে যাবে–
লিশান একটু হেসে বললেন, যার যেটা ভালো লাগে, তার সেটাই করতে হয় য়িমা। আমার এটাই ভালো লাগে।
তোমার অঙ্ক করতে ভালো লাগে?
হুঁ
কিসের অঙ্ক এটা বাবা?
লিশান একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, গত পঞ্চাশ বছরে পৃথিবীতে অনেক রকম তথ্য পাওয়া গেছে। পৃথিবীতে প্রথম যখন প্রাণের বিকাশ হয়েছিল সেই সময়ের তথ্য।
সেই তথ্য দিয়ে তুমি কী করবে?
আমি সেই তথ্য দিয়ে বের করার চেষ্টা করছি পৃথিবীতে কেমন করে প্রাণের সৃষ্টি হল।
বের করেছ বাবা?
লিশান কোনো কথা বললেন না।
বের করেছ?
লিশান একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, আমি কী করেছি আমি নিজেই জানি না য়িমা। আমি সত্যিই জানি না।
লিশানকে হঠাৎ কেমন জানি বিষণ্ণ দেখাতে থাকে, তিনি অন্যমনস্কভাবে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন।
য়িমা কোমল গলায় জিজ্ঞেস করল তুমি জান না তুমি কী বের করেছ?
লিশান জানালা দিয়ে বাইরে বিষণ্ন চোখে তাকিয়ে রইলেন, য়িমার কথা শুনতে পেলেন বলে মনে হল না। য়িমা আবার কী একটা কথা বলতে গিয়ে থেমে গেল, তার বাবা গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছেন, কোনো কথা বললে শুনতে পাবেন বলে মনে হয় না।
য়িমা বিষণ্ণ মুখে দাঁড়িয়ে রইল। বাবাকে সে একটা কথা বলতে এসেছিল, সেটা আর বলা হল না। তার ভিতরে কী একটা পরিবর্তন হচ্ছে সে বুঝতে পারছে না, ভেবেছিল বাবার। সাথে সেটা নিয়ে কথা বলবে। কিন্তু এখন সে আর বাবার সাথে সেটা নিয়ে কথা বলতে পারবে না! কে জানে শুনে বাবা হয়তো আরো বিষণ্ণ হয়ে যাবেন। সে বাবার মন খারাপ করতে চায় না, তাকে সে বড় ভালবাসে।
.
লিশান লাইব্রেরিঘরে বড় প্রসেসরের সামনে দাঁড়িয়ে স্বচ্ছ মনিটরটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। দীর্ঘদিন চেষ্টা করে খুব ধীরে ধীরে তার মস্তিষ্কের অনুকরণে সেখানে নিউরাল কম্পিউটার তৈরি হয়েছে, তিনি সেটির দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে তাকে জেগে উঠতে বললেন। সাথে সাথে একটা মৃদু গুঞ্জন শোনা গেল এবং ঘরের মাঝামাঝি প্রায় লিশানের মতোই একজন মানুষের প্রতিচ্ছবি জেগে উঠল। প্রতিচ্ছবিটি নরম গলায় বলল, কী ব্যাপার লিশান?
একা একা ভালো লাগছিল না। ভাবলাম তোমার সাথে একটু কথা বলি।
প্রতিচ্ছবিটি একটু হেসে বলল, আমি তো আসলে তোমার অনুকরণে তৈরী। আমার সাথে কথা বলা হচ্ছে নিজের সাথে কথা বলার মতো। মানুষ কি কখনো নিজের সাথে কথা বলে?
বলে।
প্রতিচ্ছবিটি হেসে বলল, হ্যাঁ, বলে। ঠিক আছে বল তুমি কী বলবে?
লিশান কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, তোমার কি মনে হয় আমার সমাধানটি সত্যি?
হা, লিশান সত্যি।
কিন্তু সেটা কী করে সম্ভব?
তুমি দেখেছ সেটা সম্ভব। তুমি একই সমস্যা তিনটি ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে সমাধান করেছ। প্রত্যেকবারই তোমার সমাধান একই এসেছে। তুমি সেখানে থাম নি, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ কম্পিউটার ব্যবহার করে সেখানে সেটাকে কৃত্রিম উপায়ে পরীক্ষা করেছ। তোমার সমাধানে কোনো ভুল নেই লিশান।
লিশান স্থির দৃষ্টিতে তার প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, আমার সমাধানটি বলেছে পৃথিবীর যে পরিবেশ ছিল সেই পরিবেশে প্রাণ সৃষ্টি হতে পারে না।
না, পারে না। প্রতিচ্ছবিটি প্রায় কঠিন গলায় বলল, তুমি সেটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছ। তুমি প্রাণের জৈব রূপ নিয়ে গবেষণা করে দেখিয়েছ তার জন্যে প্রয়োজনীয় পরিবেশ ছিল না। তুমি মহাকাশের তেজস্ক্রিয়তার পরিমাপ দিয়ে প্রমাণ করেছ সেই তেজস্ক্রিয়তায় প্রাণের সৃষ্টি সম্ভব নয়। তুমি সম্ভাব্যতার গণিত দিয়ে প্রমাণ করেছ প্রাণহীন পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির জন্যে যে পরিমাণ চাঞ্চল্য প্রয়োজন পৃথিবীতে তা ছিল না। শুধু যে ছিল না তাই নয়, লক্ষ ভাগের এক ভাগও ছিল না!
হা। লিশান মাথা নাড়লেন, আমি দেখিয়েছি।
তুমি দেখিয়েছ পৃথিবীতে যে তাপমাত্রা ছিল সেই তাপমাত্রায় অণু–পরমাণুর কম্পন কীভাবে প্রাণ সৃষ্টির অন্তরায় হতে পারে। দেখাও নি?
দেখিয়েছি।
তুমি দেখিয়েছ পৃথিবীতে দীর্ঘ সময় প্রকৃতির সুষ্ঠ শক্তি প্রবাহ হয় নি। তুমি. দেখিয়েছ সেটি সুষম নয়। শুধু যে সুষম নয় তাই নয়, প্রাণ সৃষ্টির একেবারে বিপরীত।
লিশান মাথা নাড়লেন, বললেন, আমি দেখিয়েছি।
তুমি সেটা প্রমাণ করেছ প্রস্তর–কণায় কার্বন অণুর বৈষম্য দেখিয়ে। দেখাও নি?