স্না রিফার অনুরন গোলকটি হাতের তালুতে ধরে রেখেছিল, এবারে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, রিফা, তোমার গোলকটি কি বাইরে রাখবে নাকি আবার তোমার শরীরে ঢুকিয়ে দেব?
থাকুক। বাইরে থাকুক। একটা রাত আমরা কাটাই অনুরন গোলক ছাড়া।
ক্রিক মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ কাল ভোরে আবার আমরা আগের মানুষ হয়ে যাব। ভয়ে ভয়ে থাকতে আমার বেশি ভালো লাগছে না।
শু ক্রিকের কথা শুনে আবার খিলখিল করে হাসতে শুরু করে।
.
পাঁচ জনের ছোট দলটি আগুনকে ঘিরে বসে নিচু গলায় গল্প করতে থাকে। প্রত্যেকটা মানুষের মাঝে একটা পরিবর্তন হয়েছে। তারা কেউ আর আগের মানুষ নেই, সবারই যেন একটা নতুন ব্যক্তিত্ব! কথা বলতে বলতে তারা হঠাৎ হঠাৎ চমকে উঠছিল, একে অন্যের দিকে অবাক হয়ে তাকাচ্ছিল! নিজেদের ভিতরেও তারা বিচিত্র সব অনুভূতির খোঁজ পেতে থাকে যেগুলোর অস্তিত্ব সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই ছিল না।
ছোট দলটির সবাই খুব ক্লান্ত–তবুও তাদের ঘুমোতে দেরি হয়। দীর্ঘ সময় তারা তাদের স্লিপিং ব্যাগে শুয়ে ছটফট করে একে একে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে।
গভীর রাতে হঠাৎ রিফার ঘুম ভেঙে গেল, কিছু একটা নিয়ে তার মন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। কিছু একটা তার করার ইচ্ছে করছে কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছে না সেটা কী। রিফা দীর্ঘ সময় আগুনের দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর সে স্লিপিং ব্যাগ থেকে বের হয়ে আসে। আগুনের পাশে গুটিসুটি মেরে সবাই ঘুমোচ্ছে, সে তার মাঝে ইতস্তত হাঁটতে থাকে। এক পাশে তাদের ব্যাকপেকগুলো রাখা আছে, তাদের জামাকাপড় জুতো খাবারদাবার ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। তার পাশে তাদের অস্ত্রগুলো একটা কুড়াল, কয়েকটা ছোরা। হঠাৎ রিফার সমস্ত শরীরে এক ধরনের শিহরন বয়ে গেল। কী করতে চাইছে হঠাৎ করে সে বুঝতে পেরেছে। কোনো সন্দেহ নেই আর—সে জানে, তার সমস্ত ইন্দ্রিয় সমস্ত চেতনা সমস্ত অনুভূতি হঠাৎ করে কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে পায়ে পায়ে হেঁটে সে ধারালো কুড়ালটি হাতে তুলে নেয়। সে জানে ঘুমন্ত চার মানুষের বুক কেটে তাদের হৃৎপিণ্ড বের করে আনতে হবে। কচকচ করে কী খেতে হবে হঠাৎ করে মনে পড়েছে তার। অনুরন গোলক এতদিন তার চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, হঠাৎ করে তার চেতনা উন্মুক্ত হয়ে গেছে। এখন আর তার কোনো দ্বিধা নেই। কোনো শঙ্কা নেই।
রিফা দু হাতে শক্ত করে কুড়ালটি ধরে ঘুমন্ত মানুষগুলোর দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। আগুনের আভায় তার অপূর্ব সুন্দর মুখটি চকচক করতে থাকে। সেখানে বিচিত্র একটা হাসি খেলা করছে।
ওরা
লিশান ঘরে ঢুকে দেখতে পেলেন তার মেয়ে য়িমা ঘরের মাঝামাঝি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি একটু থমকে দাঁড়ালেন, তারপর হেঁটে হেঁটে জানালার কাছে গিয়ে নরম চেয়ারটিতে হেলান দিয়ে বসলেন। য়িমা একটু এগিয়ে এসে বলল, বাবা, তুমি আমাকে দেখ নি?
দেখেছি য়িমা।
কিন্তু তুমি আমাকে দেখেও কিছু বল নি।
না, বলি নি। সবসময় কি কথা বলতে হয়?
কিন্তু তুমি আমার দিকে এগিয়ে আস নি, আমাকে স্পর্শ কর নি, আমাকে আলিঙ্গনও কর নি।
লিশান তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বললেন, য়িমা, তুমি এখান থেকে চার হাজার কিলোমিটার দূরে দাঁড়িয়ে আছ, আমার সামনে যেটি দাঁড়িয়ে আছে সেটি তুমি নও, সেটি তোমার একটা প্রতিচ্ছবি! তুমি যে কথা বলছ তার সবগুলো তোমার কথা নয়, একটি কৌশলী–যন্ত্র জানে তুমি কেমন করে কথা বল তাই সে তোমার মতো করে কথা বলছে। আমি কেমন করে একটা যন্ত্রের মুখের কথা শুনে একটা প্রতিচ্ছবিকে আলিঙ্গন করব?
য়িমা একটু এগিয়ে এসে তার বাবার দিকে নিজের হাতটি এগিয়ে দিয়ে বলল, বাবা, তুমি কী বলছ এসব? এই যে আমার হাত ধরে দেখ, দেখবে কত জীবন্ত মনে হবে।
জীবন্ত মনে হওয়া আর জীবন্ত হওয়া এক জিনিস নয় য়িমা।
য়িমা হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গি করে বলল, বাবা, তুমি একেবারে পুরোনোকালের মানুষ।
হ্যাঁ, মা, আমি খুব পুরোনোকালের মানুষ।
প্রতিদিন এত নতুন নতুন জিনিস আবিষ্কার হয় তুমি তার কোনোকিছু ব্যবহার কর না। তোমার দেহবন্ধনী নেই, তোমার দৃষ্টিসীমা নেই, তোমার যোগাযোগ বলয় নেই, তোমার আধুনিক কোনো যন্ত্রপাতি নেই। তুমি মানুষটি একেবারেই আধুনিক নও–
লিশান তার মেয়ের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে বললেন, না য়িমা, আমি মোটও আধুনিক নই! তুমি ঠিকই বলেছ। আমি আমার মেয়ের প্রতিচ্ছবি দেখে সন্তুষ্ট হতে পারি না, সত্যিকারের মেয়েটিকে দেখার জন্যে আমার বুক খা–খা করে।
য়িমা একটু আদুরে গলায় বলল, বাবা, তুমি এত বড় একজন বিজ্ঞানী, কিন্তু কিছু কিছু ব্যাপারে তুমি এত বোকা!
মেয়ের অভিযোগ শুনে লিশান একটু হেসে বললেন, সব মানুষই কোনো–না–কোনো বিষয়ে বোকা হয়–
তুমি একটু বেশি বোকা।
হ্যাঁ, মা, আমি একটু বেশি বোকা।
য়িমা অন্যমনস্কভাবে ঘরে একটু ঘুরে আবার তার বাবার কাছে এসে দাঁড়াল, জিজ্ঞেস করল, বাবা, তুমি একা একা সময় কাটাও কেমন করে?
লিশান বললেন, আমি যখন একা একা থাকি, আমার সময় কাটাতে কোনো অসুবিধে হয় না। বরং যখন লোকজন এসে যায় তখন আমার সময় নিয়ে খুব সমস্যা হয়। কী বলতে হয় টের পাই না।
আমি যখন আসি তখন?
তুমি তো আস না। তোমাকে আমি শেষবার কবে দেখেছি মনেও করতে পারি না।