হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি লিওন। তুমি কে?
আমি? অদৃশ্য জগৎ থেকে সেই প্রাণী হঠাৎ নিপ হয়ে গেল। লিওন প্রাণপণে সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে বলতে চাইল, আমি কোথায়? আমাকে দেখতে দাও। কথা বলতে দাও। আমাকে জাগিয়ে দাও। কিন্তু কেউ তার কথা শুনল না। কেউ তার কথার উত্তর দিল না।
তারপর আবার বুঝি বহুকাল কেটে গেল। কী ভয়ঙ্কর বৈচিত্র্যহীন জীবন। গভীর অন্ধকারে এক নৈঃশব্দ্যের জগৎ যার কোনো শুরু নেই, যার কোনো শেষ নেই। যে জগৎ থেকে কোনো মুক্তি নেই। দুঃখ নেই কষ্ট নেই আনন্দ–বেদনা নেই, শুধুমাত্র তিল তিল করে বেঁচে থাকা। না জানি কতকাল এভাবে বেঁচে থাকতে হবে।
তারপর আবার একদিন সে কথা শুনতে পেল, কেউ একজন তাকে জিজ্ঞেস করছে, তুমি কেমন আছ লিওন?
লিওন আকুল হয়ে বলল, ভালো নেই, আমি ভালো নেই।
কেন তুমি ভালো নেই? তোমার কি কোনো কষ্ট হচ্ছে?
না আমার কোনো কষ্ট নেই। আমার কোনো দুঃখ নেই। আনন্দ বেদনা যন্ত্রণা কিছু নেই। এ এক ভয়ঙ্কর জীবন। আমি এর থেকে মুক্তি চাই।
অদৃশ্য প্রাণী অবাক হয়ে বলল, তুমি কেমন করে মুক্তি চাও?
আমাকে জাগিয়ে দাও
দীর্ঘ সময় কেউ কোনো উত্তর দিল না, তারপর অদৃশ্য মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল। তোমাকে আমরা কেমন করে জাগাব?
মানুষকে যেভাবে জাগায়।
কিন্তু
কিন্তু কী?
অদৃশ্য জগতের সেই প্রাণী দ্বিধান্বিত গলায় বলল, তুমি তো মানুষ নও।
লিওন হতচকিত হয়ে বলল, তুমি কী বললে?
প্রাণীটি চুপ করে রইল। লিওন আতঙ্কিত গলায় বলল, আমি মানুষ নই?
না।
তাহলে আমি কী?
তুমি একটি মানুষের স্মৃতি। একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম, হলোগ্রাফিক মেমোরিতে ধরে রেখে যন্ত্রের মাঝে বাঁচিয়ে রাখা একটি মানুষের স্মৃতি। যে মানুষের স্মৃতি সেই মানুষটি বহুকাল আগে মারা গেছে। নীল চোখের সুপুরুষ একজন মানুষ।
মারা গেছে?
হ্যাঁ।
আমি সেই মানুষের স্মৃতি?
হ্যাঁ।
আমার–আমার মৃত্যু নেই?
না তোমার মৃত্যু নেই। কম্পিউটার প্রোগ্রামের মৃত্যু হয় না।
লিওন ভয়ঙ্কর আতঙ্কে পাথর হয়ে বলল, আমি এভাবে বেঁচে থাকতে চাই না, আমাকে ধ্বংস কর–ধ্বংস কর–
মানুষটি কোনো উত্তর দিল না। লিওন শুনল সে চাপা গলায় কাউকে ডাকছে, বলছে, দেখ স্মৃতির প্রোগ্রামটা কী বিচিত্র ব্যবহার করছে। এস দেখে যাও।
লিওন দেখতে পেল না কিন্তু সে জানে অনেক মানুষ একটি যন্ত্রকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। সে যন্ত্রে সে চিরদিনের জন্যে বাঁধা পড়ে আছে।
চিরদিনের জন্যে।
লিফটের যাত্রী
এটি হচ্ছে পৃথিবীর দীর্ঘতম লিফট। গাইড মেয়েটি মিষ্টি হেসে বলল, পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে এটি প্রায় পাঁচ কিলোমিটার গভীরে চলে গেছে। এই পাঁচ কিলোমিটার যেতে সময় লাগে মাত্র এক মিনিট।
লিফটের যাত্রীরা বিস্ময়সূচক এক ধরনের শব্দ করল। গাইড মেয়েটি যাত্রীদের বিস্ময়টুকু উপভোগ করে বলল, যাত্রীদের সুবিধের জন্য তাদের চেয়ারে বিশেষ সিটবেল্ট রয়েছে। এই সিটবেল্ট তাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখবে।
গাইড মেয়েটির কথা শুনে যাত্রীদের অনেকেই অকারণে আনন্দে হেসে ফেলল। মেয়েটি সবার দিকে তাকিয়ে একবার মিষ্টি হেসে বলল, পৃথিবীর গহ্বরে আপনাদের যাত্রা আনন্দময় হোক।
মেয়েটি লিফট থেকে বের হয়ে যায় এবং সাথে সাথে ঘরঘর শব্দ করে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ডের ভিতরেই লিফটটি একটি ঝাঁকুনি দিয়ে নিচে নামতে শুরু করে। সাথে সাথে ভিতরের যাত্রীরা আরেকবার আনন্দধ্বনি করে ওঠে।
লিফটের ভিতরে তৃতীয় সারির চতুর্থ যাত্রীর মাথার চুল সাদা এবং চোখে ভারি চশমা। লিফট ছেড়ে যাবার কিছুক্ষণ পর হঠাৎ তার মুখে এক ধরনের শঙ্কার ছায়া পড়ল। তিনি তার পকেটে হাত ঢুকিয়ে তার কলমটা বের করে সামনে ছেড়ে দিলেন। কলমটি নিচে না পড়ে তার সামনে ঝুলে রইল এবং সেটি দেখে তিনি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। যে জিনিসটি নিয়ে তার ভিতরে সন্দেহ হয়েছে সেটি সত্যি।
ঠিক এ রকম সময়ে পাশে বসে থাকা লাল চুলের কমবয়সী একটা মেয়ে চিৎকার করে বলল, দেখ দেখ, কলমটা পড়ছে না!
সাদা চুলের বয়স্ক মানুষটা ঘুরে মেয়েটির দিকে তাকালেন, বললেন, পড়ছে।
পড়ছে? তাহলে পড়তে দেখছি না কেন?
আমরাও পড়ছি। তাই বুঝতে পারছি না।
মেয়েটি চমকে উঠে বৃদ্ধ মানুষটির দিকে তাকাল, এবং তিনি জোর করে তার মুখে একটি হাসি ফোটানোর চেষ্টা করলেন। তার মুখের হাসিটি হল অত্যন্ত বিষণ্ণ হাসি।
লাল চুলের মেয়েটি হঠাৎ তীক্ষ্ণ স্বরে আর্তনাদ করে ওঠে এবং লিফটের সব যাত্রী অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে তার দিকে ঘুরে তাকাল।