আমি প্রস্তুত।
আপনাকে শেষবারের মতো প্রশ্ন করছি, আপনি কি স্বেচ্ছায় শীতলঘরে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন?
লিওন শান্ত গলায় বলল, হ্যাঁ, আমি স্বেচ্ছায় শীতলঘরে প্রবেশ করতে যাচ্ছি।
আপনি জানেন যে কবে আপনাকে পুনরুজ্জীবিত করা হবে সেটা কেউ জানে না।
আমি জানি।
সেটা এক শ বছর হতে পারে, এক হাজার বছর হতে পারে আবার এক লক্ষ বছর হতে পারে।
আমি জানি।
আপনাকে কখনো পুনরুজ্জীবিত নাও করা হতে পারে। শীতলঘরেই আপনার মৃত্যু হতে পারে।
আমি জানি।
ভবিষ্যতে কিছু একটা সমস্যা হতে পারে, দুর্যোগ হতে পারে। আপনার দেহ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
আমি জানি।
আপনার দেহ পুনরুজ্জীবিত করার পর কিছু একটা বড় ধরনের ভুল হয়ে যেতে পারে, আপনার দেহে অকল্পনীয় বিকৃতি হতে পারে, আপনার অমানুষিক যন্ত্রণা হতে পারে, অসহনীয় কষ্ট হতে পারে। আপনি সেটা জানেন?
লিওন চেষ্টা করে নিজের গলার স্বরকে স্বাভাবিক রেখে বলল, আমি সেটা জানি।
বেশ, মহামান্য লিওন। আপনাকে তাহলে শীতলঘরে নিয়ে যাব। প্রথমে আপনাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হবে, গভীর ঘুম। সেই ঘুমন্ত দেহের তাপমাত্রা কমিয়ে আনব ধীরে ধীরে। আপনি প্রস্তুত?
আমি প্রস্তুত।
আপনি কি কাউকে কিছু বলে যেতে চান?
চাই। আমার ভালবাসার মেয়েটির নাম ত্রিণা। আমি ত্রিণাকে বলে যেতে চাই যে আমি তাকে ভালবাসি, লক্ষ বছর পরেও যখন আমাকে পুনরুজ্জীবিত করা হবে তখনো আমি তাকে ভালবাসব।
টেকনিশিয়ানটি এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, আমি মহামান্য ত্রিণাকে আপনার শেষ কথাটি জানিয়ে দেব। আপনার ভবিষ্যৎ যাত্রা শুভ হোক মহামান্য লিওন। শুভ যাত্রা।
টেকনিশিয়ানের কথাটি শেষ হবার আগেই সিলঝিনিয়ামের কালো ক্যাপসুলটির মাঝে খুব ধীরে ধীরে একটা সঙ্গীতের সুর ভেসে আসে, তার সাথে খুব মিষ্টি একটা গন্ধ। লিওন চোখ বন্ধ করে ফিসফিস করে বলল, বিদায় পৃথিবী। বিদায়। কিছুক্ষণের মাঝেই সে গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ে।
০৩.
গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে আছে। শুধু অন্ধকার নয় সাথে এক ধরনের বিস্ময়কর নীরবতা, পরিপূর্ণ শব্দহীনতা। নৈঃশব্দ্যের এক বিচিত্র জগৎ। বিশাল শূন্যতায় মহাকাল যেন স্থির হয়ে আছে। এই শূন্যতার কোনো শুরু নেই, কোনো শেষ নেই। এখানে সময় স্থির হয়ে আছে। গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে থাকা স্থির সময়ে নৈঃশব্দ্যের একটি অপার্থিব জগৎ।
০৪.
অন্ধকার নৈঃশব্দ্যের জগতে চেতনার প্রথম স্পর্শ হল খুব সাবধানে। অত্যন্ত সূক্ষ্ম সেই অনুভূতি। এত সূক্ষ্ম সেই অনুভূতি যে সেটি আছে কি নেই সেটি বোঝা যায় না। মনে হয়। একটি নিউরন বুঝি পাশের নিউরনকে স্পর্শ করেছে খুব সাবধানে। সেই সূক্ষ্ম অনুভূতি জেগে রইল বহুকাল। তারপর সেটি আরো একটু বিস্তৃত হল। আরো একটু প্রবল হল। এখন সেটি সত্যিকারের অনুভূতি। সত্যিকারের চেতনা। সেটি সুখের চেতনা নয়, দুঃখের চেতনা নয়। আনন্দ বা বেদনার চেতনা নয়। শুধুমাত্র অনুভব করা যায় সেরকম একটি চেতনা। লিওন প্রথমবার তার অস্তিত্বকে অনুভব করল, প্রথমবার নিজেকে বলল, আমি লিওন। আমি বেঁচে আছি। বেঁচে আছি।
কিন্তু বেঁচে থাকার সেই অনুভূতি খুব অস্পষ্ট অনুভূতি। সত্যি কি সে লিওন? সত্যি কি সে বেঁচে আছে? নাকি এটি ধরাছোঁয়ার বাইরের একটি অনুভূতি। শুধু একটি অনুভূতি? লিওন দীর্ঘকাল আবছায়ার মতো সেই অনুভূতিকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে রইল। তারপর একদিন সেই অনুভূতি আরো একটু স্পষ্ট হল, আরো একটু প্রবল হল। লিওন প্রথমবার অনুভব করল সে সত্যি লিওন। সে সত্যি বেঁচে আছে, তার অনুভূতিও সত্যি। দুঃখ, কষ্ট, ভালবাসা, আনন্দ, যন্ত্রণা নয়, শুধু একটি অনুভূতি–সত্যিকারের অনুভূতি।
সেই অনুভূতির জগৎ গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা, সেখানে কোনো আলো নেই, শব্দ নেই, কারো স্পর্শ নেই, কম্পন নেই। পরিপূর্ণ নৈঃশব্দ্যের এক অপার্থিব শীতল অন্ধকার জগৎ। কতকাল তাকে অসহায়ভাবে অপেক্ষা করতে হবে?
ধীরে ধীরে তার চেতনা আরো প্রবল হয়,অনুভূতি আরো স্পষ্ট হয়। সে নিজেকে আরো গভীরভাবে অনুভব করে। তার স্মৃতি ফিরে আসে। তার শৈশবের কথা মনে হয়, যৌবনের কথা মনে হয়। ব্যর্থতার কথা মনে হয়, সাফল্যের কথা মনে হয়। তার ভালবাসার কথা মনে হয়, ত্রিণার কথা মনে হয়। কোথায় আছে এখন ব্রিণা? কত বছর পার হয়েছে এখন? কতকাল? কোথায় আছে এখন সে? নিশ্চয়ই সে মারা গেছে বহুকাল আগে। কখন সে কারো একটু কথা শুনবে? একটু দেখবে? একটা কিছু স্পর্শ করবে? কখন সে একটু কথা বলবে?
চারদিকে গাঢ় অন্ধকার, নৈঃশব্দ্যের দুর্ভেদ্য দেয়াল দিয়ে ঢাকা। তার মাঝে সমস্ত চেতনা উন্মুখ করে লিওন অপেক্ষা করে। একটু আলোর জন্যে অপেক্ষা করে একটু শব্দ, একটু হাতের ছোঁয়া। কিন্তু মহাকাল যেন স্থির হয়ে গেছে, তার বুঝি আর মুক্তি নেই। নিঃসীম অন্ধকারে বুঝি সে চিরকালের জন্যে বাঁধা পড়ে গেছে।
একদিন সে প্রথমবার একটা শব্দ শুনতে পেল। সত্যিই কি শব্দ? নাকি কেউ চেতনায় এসে প্রশ্ন করেছে? কে একজন ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, তুমি কে?
লিওন আকুল হয়ে বলতে চাইল, আমি লিওন। লিওন। কিন্তু সে কোনো কথা বলতে পারল না। কেমন করে বলবে? তার চেতনা ছাড়া এখনো যে কিছুই নেই।
কিন্তু কী আশ্চর্য! যে প্রশ্ন করেছে সে তার কথা বুঝতে পারল, তাকে বলল, তুমি লিওন?