মনে হয় সেজন্যেই।
কী বলছ তুমি!
হ্যাঁ ত্রিণা। লিওন বিষণ্ণ গলায় বলল, মনে হয় সেজন্যেই আমার আর বেঁচে থাকার ইচ্ছে করে না। একজন মানুষের জীবনে যা–কিছু পাওয়া যেতে পারে আমি তার সব পেয়েছি। অর্থ বিত্ত মান সম্মান সাফল্য এমনকি ভালবাসা–সত্যিকারের ভালবাসা, তাও আমি পেয়েছি তোমার কাছে। আমার দেহে কোনো রোগ নেই, আমার বুকে কোনো শোক নেই, জীবনে কোনো ব্যর্থতা নেই, কোনো জটিলতা নেই, কোনো কুটিলতা নেই, কোনো হিংস্রতা নেই–কী ভয়ঙ্কর একঘেয়ে জীবন। একজন মানুষ যখন সবকিছু পেয়ে যায়, যখন তার জীবন একদম একঘেয়ে হয়ে যায় তখন জীবনের ওপর ঘেন্না ধরে যায়, আর বেঁচে থাকার ইচ্ছে করে না। সবকিছু তখন এত অর্থহীন মনে হয়।
মিথ্যা কথা! ত্রিণা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, সব মিথ্যা কথা। মানুষের জীবন কখনো অর্থহীন হয়ে যায় না।
যায়। লিওন একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমার জীবন অর্থহীন হয়ে গেছে।
ত্রিণা হঠাৎ লিওনকে ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর ভয় পাওয়া গলায় বলল, তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে লিওন
লিওন চমকে উঠে ত্ৰিণার দিকে তাকাল, কী একটা বলতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, তুমি এ কথাটি কেন বললে ত্রিণা?
আমি জানি না কেন বলেছি। কিন্তু তোমার কথা শুনে কেন জানি মনে হল তুমি বুঝি আমাকে ছেড়ে যাবে লিওন। তুমি কি সত্যিই যাবে?
লিওন কোনো কথা বলল না। ত্রিণার মুখ খুব ধীরে ধীরে রক্তশূন্য হয়ে আসে, সে পিছনে সরে এসে ঘরের দেয়াল ধরে কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে ভয় পাওয়া চোখে লিওনের দিকে তাকিয়ে থাকে। লিওন এক পা এগিয়ে এসে আবার নরম গলায় বলল, তুমি এ রকম একটি কথা কেন বললে ত্রিণা?
ত্ৰিণা অপ্রকৃতিস্থের মতো মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, আমি জানি, আমি জানি তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। আমি তোমার চোখের দিকে তাকালেই বুঝতে পারি।
লিওন কেমন যেন বিষণ্ণ চোখে ত্রিণার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার চোখ ঘুরিয়ে নেয়। স্বচ্ছ কোয়ার্টজের জানালা দিয়ে আবার বাইরে তাকাল তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ত্রিণা, বাইরে তাকিয়ে দেখ, কুয়াশায় সব ঢেকে যাচ্ছে আর দেখতে কী সুন্দর লাগছে!
লিওনের গলার স্বর শুনে ত্রিণা আবার শিউরে উঠে কাঁপা গলায় বলল, তুমি কোথায় যাবে লিওন?
লিওন বাইরের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি শীতলঘরে যাব।
শীতলঘরে?
হ্যাঁ ত্রিণা। প্রথমে ভেবেছিলাম আত্মহত্যা করব। দশ তলা একটি বিল্ডিং থেকে নিচে ঝাঁপিয়ে পড়া বা মাথার মাঝে একটা ছোট বুলেট কিংবা ধমনীতে এক ফোঁটা বিষয় কিংবা অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে গভীর একটা ঘুম। যখন ঘুমের কথা ভাবছিলাম তখন হঠাৎ শীতলঘরের কথা মনে হল। সেটি মৃত্যুর মতোই কিন্তু তবু পুরোপুরি মৃত্যু নয়। হয়তো ভবিষ্যতে কোনোকালে আবার জীবন ফিরে পাব। সেটি কবে হবে কেউ জানে না। হয়তো এক শ বছর বা এক হাজার বছর। কিংবা কে জানে হয়তো লক্ষ বছর, কেউ সেটা বলতে পারে না। পৃথিবী কেমন হবে তখন কেউ জানে না। হয়তো আমার জীবন তখন এ রকম একঘেয়ে মনে হবে না, এ রকম অর্থহীন হবে না। কে জানে ভবিষ্যতের সেই মানুষের জীবনে হয়তো আবার বেঁচে থাকার একটা অর্থ খুঁজে পাওয়া যাবে।
ত্রিণা দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে ছিল, তার সমস্ত শরীর অল্প অল্প করে কাঁপছে। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই অসম্ভব রূপবান মানুষটিকে ঘিরে তার সমগ্র জীবন। এর বাইরে তার কোনো জগৎ নেই–এই মানুষটিকে ছাড়া সে কেমন করে বাঁচবে? তার দুই চোখ পানিতে ভরে আসে, চোখের সামনে সবকিছু ঝাঁপসা হয়ে আসে, হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ মুছে সে ভাঙা গলায় বলল, লিওন তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যেও না। যেও না। আমি আর তুমি চলে যাব দক্ষিণের পাহাড়ি অঞ্চলে। সবকিছু ছেড়ে চলে যাব। নিঃস্ব মানুষ যেরকম কষ্ট করে বেঁচে থাকে, ঠিক সেরকম আমরা কষ্ট করে বেঁচে থাকব। দেখবে তখন তোমার জীবনকে অর্থহীন মনে হবে না। সারাদিন ঘুরে ঘুরে আমরা জ্বালানি আনব, একমুঠো খাবার আনব, রাতে আমরা সেই একমুঠো খাবার ভাগাভাগি করে খেয়ে আগুনের সামনে বসে থাকব। দেখবে তুমি তোমার জীবনকে একঘেয়ে মনে হবে না, অর্থহীন মনে হবে না।
লিওন কয়েক পা এগিয়ে এসে ত্রিণাকে গভীর ভালবাসায় আলিঙ্গন করে কোমল গলায় বলল, আমি দুঃখিত ত্ৰিণা, আমি খুব দুঃখিত। পৃথিবীতে তুমি ছাড়া আমার কোনো আপনজন নেই, তোমাকে ছেড়ে যেতে আমার খুব কষ্ট হবে কিন্তু আমাকে যেতেই হবে। আমাকে যেতেই হবে। আমি আর পারছি না ত্রিণা।
ত্ৰিণা হঠাৎ আকুল হয়ে কেঁদে উঠল। শক্ত হাতে লিওনকে আঁকড়ে ধরে বলল, না লিওন। তুমি যেও না। যেও না।
লিওন ত্রিণার মাথায় হাত বুলিয়ে গভীর ভালবাসায় বলল, আমাকে যেতেই হবে ত্রিণা। আমার আর কিছু করার নেই।
গভীর শূন্যতায় হঠাৎ ত্রিণার বুকের ভিতর হাহাকার করে ওঠে।
০২.
লিওন কানো একটি সিলঝিনিয়ামের ক্যাপসুলে শুয়ে আছে। তার সারা শরীর নিও পলিমারের অর্ধস্বচ্ছ কাপড়ে ঢাকা। মাথার কাছে একটি গোল জানালা, সেখানে একজন কমবয়সী টেকনিশিয়ানের মুখ দেখা যাচ্ছে। ক্যাপসুলটির বাইরে কন্ট্রোল প্যানেলে সে কিছু একটা করছে। টেকনিশিয়ানটি হঠাৎ ঝুঁকে পড়ে বলল, আপনি কি প্রস্তুত?