১. দূর হতে চিঠি এসেছে।
২. দূর হতে খবর এসেছে।
৩. দূর হতে বার্তা এসেছে।
( আরো তিন শ মিলি সেকেন্ড পরে)
দেখা যাচ্ছে আমার মনিব পরবর্তী শব্দটি উচ্চারণ করার জন্যে প্রস্তুতি নিয়েছেন। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তার ভোকাল কর্ড কম্পনের জন্যে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। মানুষের কথা বিশ্লেষণ করার সময় তাদের মুখের ভাবভঙ্গিও বিশ্লেষণ করতে হয়। আমি যদি আমার মনিবের মুখের ভাবভঙ্গি মান এবং গুরুত্বের ক্রমানুসারে সাজাই তাহলে সেগুলো হবে :
১. ক্রোধ।
২. বিরক্তি
৩. অধৈর্য
৪. ঘৃণা
৫. তাচ্ছিল্য
এবং
৬. উপহাস
মানুষের মুখে যদি এই অনুভূতিগুলো থাকে তাহলে সেগুলো সাধারণত তাদের বক্তব্যে বিচিত্র শব্দ এবং অপ্রাসঙ্গিক অর্থের সৃষ্টি করে। এটি একটি জরুরি অবস্থা। আমার মনে হয় কপোট্রনের টার্বো পাওয়ার চালু করা উচিত। প্রতি সেকেন্ডে আমার এখন অন্তত পঞ্চাশ ট্রিলিয়ন তথ্য পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। পরবর্তী শব্দটি পর্যালোচনা করার জন্য এখন আমার বিশেষ মডিউলটি চালু করা প্রয়োজন। এটি নিঃসন্দেহে একটি জরুরি অবস্থা। আমার মনিবের ভোকাল কর্ডের কম্পন শুরু হয়ে গেছে। তিনি যে শব্দটি উচ্চারণ করেছেন সেটি হচ্ছে :
হতভাগা
হতভাগা। এটি বহুল ব্যবহৃত শব্দ নয়। আমার কপোট্রনের অর্থ অনুযায়ী এই শব্দের অর্থ যার ভাগ্য সুপ্রসন্ন নয়। ভাগ্য শব্দটি শুধুমাত্র মানবসমাজে ব্যবহৃত। কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাকে তারা খারাপ ভাগ্যপ্রসূত বলে বর্ণনা করে। এই ক্ষেত্রে হতভাগা শব্দটি কাকে বলা হয়েছে সেটা সবার আগে নির্ধারণ করতে হবে। এই ঘরে আমি ছাড়া আর কেউ নেই তাই শব্দটি নিঃসন্দেহে আমার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে। আমার উদ্দেশ্যে উচ্চারণ করা। এখন তিনটি পূর্ণাঙ্গ শব্দ রয়েছে। মনিবের মুখভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তিনি একটি পূর্ণাঙ্গ বাক্য উচ্চারণ করেছেন। এই বাক্যটিতে আর কোনো শব্দ নেই। এখন এই তিনটি শব্দ ব্যবহার করে যে বাক্য তৈরি হয়েছে সেটি হচ্ছে :
দূর হ হতভাগা
বাক্যটি বিশ্লেষণের প্রয়োজন। বাক্যটি ব্যবহার করার সময়ে আমার মনিবের মুখের অনুভূতিও পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। মুখের অনুভূতি হচ্ছে ক্রোধ, বিরক্তি, অধৈর্য, ঘৃণা, তাচ্ছিল্য এবং উপহাস। এই অনুভূতিগুলো মুখে রেখে তিনি উচ্চারণ করেছেন, ‘দূর হ হতভাগা’। আমার হাতে সময় রয়েছে প্রায় অর্ধসেকেন্ড। এই সময়ের মাঝে আমাকে এই বাক্যটির অর্থ বের করে একটি প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এটি নিঃসন্দেহে একটি জটিল প্রক্রিয়া ….।
লিওনের একঘেয়ে জীবন
০১.
ঘরে ঢুকতেই ত্ৰিণার বুকটি কেন জানি কেঁপে উঠল। কোয়ার্টজের স্বচ্ছ জানালার সামনে মূর্তির মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে লিওন। অসাধারণ রূপবান এই মানুষটির এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার মাঝে কী যেন একটা অস্বাভাবিকতা আছে, হঠাৎ দেখলে বুকের মাঝে কোথায় জানি একটা ছোট ধাক্কা লাগে। লিওনকে দেখে ত্রিণা হঠাৎ কেন জানি ব্যাকুল হয়ে উঠে, দুই পা এগিয়ে গিয়ে নরম গলায় বলল, লিওন–
লিওন ঘুরে তাকাল। তার মাথার চুল এলোমেলো। অনিন্দ্যসুন্দর মুখে এক ধরনের কাঠিন্য, জ্বলজ্বলে নীল চোখ দুটিতে এক ধরনের অসুস্থ অস্থিরতা। ত্রিণাকে দেখে তার মুখের কাঠিন্য সরে সেখানে খুব ধীরে ধীরে এক ধরনের অসহায় বিষণ্ণতা ভর করে। ত্রিণা আরো এগিয়ে গিয়ে বলল, তোমার কী হয়েছে লিওন?
লিওন কয়েক মুহূর্ত ত্রিণার দিকে তাকিয়ে থেকে আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। স্বচ্ছ কোয়ার্টজের জানালা দিয়ে বাইরের আদিগন্ত বিস্তৃত শহরটিকে দেখাচ্ছে একটা অপার্থিব জগতের মত। সেদিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে লিওন একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে বলল, বাইরে দেখ, কী সুন্দর!
লিওনের গলার স্বর শুনে ত্রিণা হঠাৎ কেন জানি শিউরে ওঠে। সে এগিয়ে গিয়ে লিওনের হাত স্পর্শ করে এক ধরনের আর্তকণ্ঠে বলল, তোমার কী হয়েছে লিওন?
আমার কিছু হয় নি।
হয়েছে। নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। বল আমাকে।
লিওন ঘুরে ত্ৰিণার দিকে তাকাল, তার সোনালি চুল, কোমল ত্বক, মুখে ছেলেমানুষি এক ধরনের সারল্য, শরতের নির্মেঘ আকাশের মতো নীল চোখ এবং এই মুহূর্তে চোখ দুটিতে এক ধরনের অসহায় ব্যাকুলতা। লিওন একজন নিঃসঙ্গ মানুষ, সারা পৃথিবীতে শুধুমাত্র এই মেয়েটির জন্যে তার বুকের ভিতরে সত্যিকারের খানিকটা ভালবাসা রয়েছে। সে ত্রিণাকে নিজের কাছে টেনে এনে বলল, আমার কিছু হয় নি ত্রিণা।
ত্রিণা মাথা নেড়ে বলল, না লিওন হয়েছে। আমি তোমাকে খুব ভালো করে জানি। আমি নিজেকে যেটুকু জানি, সময় সময় তোমাকে তার থেকে অনেক ভালো করে জানি। তোমার কিছু একটা হয়েছে।
লিওন একদৃষ্টিতে ত্ৰিণার দিকে তাকিয়ে রইল, কিছু বলল না। ত্রিণা আবার ব্যাকুল গলায় বলল, বল আমাকে।
বলব?
হ্যাঁ, বল কী হয়েছে তোমার?
লিওন একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে বাইরের দিকে তাকিয়ে থেকে নিচু গলায় বলল, আমার আর বেঁচে থাকার ইচ্ছে করছে না ত্রিণা।
ত্রিণা হঠাৎ অমানুষিক আতঙ্কে শিউরে উঠে লিওনকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বলল, না, লিওন এ রকম কথা বোলো না।
আমি বলতে চাই নি, তুমি শুনতে চেয়েছ।
কিন্তু তোমার কথা তো সত্যি হতে পারে না। পৃথিবীতে একজন মানুষ তার জীবনে যা চাইতে পারে তুমি তার সব পেয়েছ, তোমার কেন বেঁচে থাকার ইচ্ছে করবে না?