ভোরবেলা সূর্যের প্রথম আলোকে পুরো দলটির মাঝে এক ধরনের উৎসাহের সঞ্চার হয়, তারা কোনোরকম সাহায্য ছাড়া একা একা গভীর অরণ্যে রাত কাটিয়েছে ব্যাপারটি অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। পরের দিনের পথ ছিল আরো দুর্গম কিন্তু কোনো একটি অজ্ঞাত কারণে পুরো দলটির কাছে সেটি আর দুর্গম বলে মনে হয় না। প্রবল আত্মবিশ্বাসে তারা নিজেদের টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকে, ঝোঁপঝাড়ে লেগে তাদের শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে আসে, অসহনীয় পরিশ্রমে তাদের দেহ অবশ হয়ে আসে তবুও তারা কোনো একটি অজ্ঞাত শক্তির প্রেরণায় হেঁটে যেতে থাকে।
তারা যখন তাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছাল তখন বেলা ডুবে গেছে। ক্লান্তিতে তখন আর কেউ দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। কোনোভাবে একটা আগ্রুন জ্বালিয়ে সবাই জড়াজড়ি করে বসে থাকে। খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে এবং অল্প কিছু খেয়ে যখন তাদের মাঝে খানিকটা শক্তি ফিরে এল তখন আবার তারা কথাবার্তা বলতে শুরু করে। গরম একটা পানীয় চুমুক দিয়ে খেতে খেতে রিফা বলল, আমরা সত্যিই তাহলে করেছি!
ক্রিক মাথা নাড়ল, হা, করেছি
কোনরকম সাহায্য ছাড়া আমরা গত দুদিন থেকে হাঁটছি। একেবারে প্রাচীনকালের মানুষের মতো!
শু রিফার দিকে তাকিয়ে হাসল, বলল, একেবারে প্রাচীনকালের মানুষের মতো! শরীরের শক্তিই হচ্ছে সবকিছু।
ক্রিক মাথা নাড়ল, হ্যাঁ, কোনো যন্ত্রপাতি নেই, কোনো প্রযুক্তি নেই, শুধুমাত্র আমাদের শক্তি! আমাদের সাহস।
রিফা তার গরম পানীয়টিতে চুমুক দিয়ে বলল, ব্যাপারটা আসলে খারাপ নয়। আমার তো মনে হচ্ছে বেশ চমৎকার একটা ব্যাপার। যন্ত্রপাতি থেকে কোনো সাহায্য পাওয়া যায় না বলে একে অন্যকে সাহায্য করতে হয়, নিজেদের মাঝে কী সুন্দর একটা পরিবার পরিবার সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
স্বল্পভাষী স্না মাথা নাড়ল, বলল, ঠিকই বলেছ। প্রাচীনকালের সমাজের খুঁটি সেজন্যে খুব শক্ত ছিল। এখন সেরকম পাওয়া খুব সহজ নয়।
রিফা সামনের বিশাল আগুনের কুণ্ডলীটাতে এক টুকরা শুকনো কাঠ ছুঁড়ে দিয়ে বলল, এখানে এসে আমার যে কী ভালো লাগছে তোমাদের বোঝাতে পারব না। মনে হচ্ছে সবকিছু কচকচ করে খেয়ে ফেলি!
দলের অন্য সবাই এক ধরনের স্নেহের চোখে রিফার দিকে তাকাল, মেয়েটির মাঝে এক ধরনের নির্দোষ সারল্য আছে যেটা প্রায় সময়েই খুব স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়ে যায়।
.
গভীর রাতে যখন সবাই ঘুমানোর আয়োজন করছে তখন হঠাৎ লন সবার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, আমার হঠাৎ একটা কথা মনে হয়েছে।
ক্রিক কৌতূহলী চোখে বলল, কী কথা?
আমরা বলাবলি করছি যে আমরা গত দুদিন প্রাচীনকালের মানুষের মতো বেঁচে আছি।
হ্যাঁ। কী হয়েছে তাতে?
কথাটা সত্যি নয়।
সত্যি নয়? কেন?
আমাদের সবার কাছে একটা জিনিস রয়েছে যেটা প্রাচীনকালের মানুষের কাছে ছিল না।
কী?
অনুরন গোলক।
রিফা ভুরু কুঁচকে বলল, অনুরন গোলকের সাথে এর কী সম্পর্ক?
আছে, সম্পর্ক আছে। অবশ্যি আছে।
কীভাবে আছে?
বলছি শোন। লন আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে বলল, আমাদের গত দুদিনের কথা চিন্তা কর, আমরা কী করেছি?
হেঁটে হেঁটে এসেছি।
হ্যাঁ। লন মাথা নেড়ে বলল, অত্যন্ত দুর্গম একটা পথ দিয়ে হেঁটে হেঁটে এসেছি। যখন রিফা খুব ক্লান্ত হয়ে গেছে তখন আমরা কী করেছি?
রিফার মালপত্র অন্যেরা ভাগাভাগি করে এনেছি।
হ্যাঁ। আমরা কেউ কি রিফার ওপরে বিরক্ত হয়েছি?
শু একটু অবাক হয়ে বলল, বিরক্ত কেন হব?
হওয়ার কথা। প্রাচীনকালের মানুষ হলে বিরক্ত হত। রাগ হত। যে দুর্বল তাকে সবাই ত্যাগ করে যেত। যারা সবল তারা একে অন্যের সাথে নেতৃত্ব নিয়ে যুদ্ধ করত। প্রয়োজনে তারা স্বার্থপর হত। কিন্তু আমরা হই না। জন্মের পরই আমাদের মস্তিষ্ক স্ক্যান করে আমাদের সবার শরীরে প্রয়োজনমাফিক নির্দিষ্ট অনুরন গোলক ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা তাই অন্যরকম মানুষ। আমাদের মাঝে রাগ নেই, হিংসা নেই, আমাদের মাঝে লোভ নেই। আমরা একে অন্যকে সাহায্য করি। একজন মানুষ এমনিতে যেটুকু ভালো হওয়ার কথা, আমরা তার থেকে অনেক বেশি ভালো। গত শতাব্দীকে পৃথিবীতে মানুষ যুদ্ধ করে নি, একে অন্যকে শোষণ করে নি–তার কারণ হচ্ছে অনুরন গোলক। মানুষের মাঝে যেটুকু সীমাবদ্ধতা আছে সব সরিয়ে নিয়েছে এই অনুরন গোলক।
ক্রিক তীক্ষ্ণ চোখে লনের দিকে তাকিয়ে বলল, তার মানে তুমি বলছ আমরা এখনো প্রাচীনকালের মানুষের অনুভূতির খোঁজ পাই নি?
না। ব্যাপারটা সেই বিংশ শতাব্দী থেকে শুরু হয়েছে, যখন মানুষ আবিষ্কার করেছে একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব আসলে তার মস্তিষ্কের জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়া বিশেষ ওষুধ দিয়ে সেই বিক্রিয়ার পরিবর্তন করা যায়, যেই মানুষ বদ্ধ উন্মাদ তাকে সুস্থ করে দেয়া যায়, যেই মানুষ বিষণ্ণতায় ভুগছে তাকে উৎফুল্ল করে দেয়া যায়, তখন থেকে মানুষের ব্যক্তিত্বকে পাল্টে দেয়া শুরু হয়েছে। মানুষের সব সীমাবদ্ধতা সরিয়ে নেয়া শুরু হয়েছে। আমরা প্রাচীনকালের মানুষ থেকে অনেক ভিন্ন, অনেক যত্ন করে আমাদের প্রস্তুত করা হয়। এই শতাব্দীতে কোনো উন্মাদ নেই, খুনে নেই, খ্যাপা নেই, স্কৃতজোফ্রেনিয়া রোগী নেই—
রিফা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তার মানে আমাদের এই কষ্ট এই পরিশ্রম সব অর্থহীন? আসলে আমরা জানি না প্রাচীনকালের মানুষের অনুভূতি কী রকম?