জাহিদকে ছেড়ে দেয়া মাত্র সে চিৎকার করে বলল, দাঁড়া ব্যাটা বদমাইশ ধড়িবাজ। আমি তোর বারটা বাজাচ্ছি। মাঝরাতে আমার বউয়ের সাথে প্রেম করা ছুটিয়ে দিচ্ছি।
জাহিদ তার ভিডিফোনটা নিয়ে এসে কাঁপা হাতে ডায়াল করল, প্রায় সাথে সাথেই সেখানে ফ্যাক্টরির সিকিউরিটি ডিভিশনের একজন লোকের চেহারা ভেসে ওঠে। মানুষটি উদ্বিগ্ন গলায় বলল, এত রাতে কী ব্যাপার? কী হয়েছে?
তুমি এই মুহূর্তে আবদুল্লাহর সার্কিট কেটে দাও।
কেন কী হয়েছে?
ব্যাটা বদমাইশ আমার সাথে আমার সাথে
আপনার সাথে কী করেছে?
না, মানে রাত্রিবেলা আমার স্ত্রীকে
ভিডিফোনে অন্য পাশের মানুষটিকে খুব কৌতূহলী দেখা গেল। ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, কী করেছে আপনার স্ত্রীকে?
জাহিদ ক্রুদ্ধ গলায় বলল, সেটা তোমার শোনার দরকার নেই। আমার অথরিটি আছে, আমি বলছি। এই মুহূর্তে কানেকশান কেটে দাও—
এক মিনিট অপেক্ষা করুন। মানুষটি স্ক্রিন থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল এবং মিনিট দুয়েক পরে আবার তাকে দেখা গেল, তার সাথে আরো একজন উচ্চপদস্থ মানুষ। মানুষটি গম্ভীর গলায় বলল, কে.এল. ৪২–এর কানেকশান কাটতে বলেছেন, কিন্তু সত্যিকার বিপদের ঝুঁকি না থাকলে আমরা সেটা কাটতে পারি না। নিয়ম নেই।
জাহিদ ভিডি টেলিফোনটা ঝাঁকিয়ে বলল, বিপদের নিকুচি করছি। এই মুহূর্তে কানেকশান কেটে রবোটটাকে অচল কর। এই মুহূর্তে। আমার অর্ডার
ভিডি স্ক্রিনের মানুষটা একটু বাঁকা করে হেসে বলল, আপনার ব্যাপারটাতে আমাদের জিএম ইমতিয়াজ সাহেব খুব কৌতূহল দেখিয়েছেন। সত্যি কথা বলতে কী, তিনি নিজেই আপনার বাসায় আসছেন।
জাহিদ হতচকিতভাবে বলল, জিএম? ইমতিয়াজ সাহেব? এখন আসছেন? এত রাতে?
হ্যাঁ, এখনই আসছেন। আপনি সোজাসুজি তার সাথে কথা বলতে পারবেন।
ভিডি স্ক্রিনের মানুষটি মুখে হাসি ফুটিয়ে কল, গুড নাইট।
জাহিদ কোনো উত্তর না দিয়ে ভিডিফোনটাকে আছাড় দিয়ে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলল।
.
রবোট ফ্যাক্টরির জিএম ইমতিয়াজ আহমেদ একজন আইনজ্ঞ এবং একজন ইঞ্জিনিয়ারকে নিয়ে গভীর রাতে জাহিদ এবং নাসরীনের বাসায় উপস্থিত হলেন। ততক্ষণে জাহিদের অন্ধ আক্রোশ কমে সেখানে তার স্ত্রী এবং আবদুল্লাহর প্রতি এক ধরনের বিজাতীয় বিদ্বেষ আর ঘৃণা স্থান করে নিয়েছে। ইমতিয়াজ আহমেদ কিন্তু জাহিদের সাথে কথা বলায় বেশি আগ্রহ দেখালেন না, দীর্ঘ সময় নাসরীনের সাথে কথা বললেন। তার মুখে তিনি যেটা শুনলেন সেটা তার পক্ষে বিশ্বাস করা খুব শক্ত, কয়েকবার শুনেও তিনি ঠিক বিশ্বাস করতে পারলেন না, মাথা নেড়ে বললেন, তুমি বলছ যে তোমার বার বছরের বিবাহিত স্বামীকে ছেড়ে দিয়ে এই রবোটের সাথে ঘর–সংসার করবে?
হ্যাঁ।
তুমি ঠাণ্ডা মাথায় বলছ?
হ্যাঁ, আমি ঠাণ্ডা মাথায় বলছি। আবদুল্লাহ রবোট হতে পারে কিন্তু তার ভিতরে রয়েছে একটা অনুভূতিশীল মন। তার তুলনায় আমার স্বামী একটি নিচু শ্রেণীর পশু।
জাহিদ বাধা দিয়ে বলল, এটা পাগলামি, বদ্ধ পাগলামি
ইমতিয়াজ আহমেদ হাত তুলে জাহিদকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, এটা পাগলামি না কী সেটা নিয়ে আলোচনা করার অনেক সময় পাওয়া যাবে। তার জন্যে আমাদের দুটি বড়। বিভাগই আছে। কিন্তু তোমার স্ত্রী আমাদের সামনে সম্ভাবনার বিশাল একটা জগৎ খুলে দিয়েছে।
জাহিদ অবাক হয়ে ইমতিয়াজ আহমেদের দিকে তাকাল। ইমতিয়াজ আহমেদ উত্তেজিত গলায় বললেন, পৃথিবীতে বিবাহিত স্বামী–স্ত্রীদের একটা বিশাল অংশ অসুখী। তাদের আবার বিশাল একটা অংশ তাদের স্বামীদের আচার–আচরণে এত বিরক্ত হয়েছে, তাদের এত ঘেন্না করে যে মানুষ জাতিটার প্রতিই তাদের ভক্তি উঠে গেছে। তারা এখন মানুষের বদলে রবোটকে নিয়ে ঘর–সংসার করার জন্য প্রস্তুত। এই রবোটেরা আবেগবান, সংস্কৃতিবান। তাদের মাঝে কোনো রাগ নেই, শুধু তাই না তারা অসম্ভব সুদর্শন! আমরা যদি এ রকম আরো রবোট তৈরি করে ঠিকভাবে মার্কেটিং করি সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটে যাবে।
পাশে বসে থাকা আইনজ্ঞ মানুষটি পকেট থেকে একটা ছোট কম্পিউটার বের করে। তার মাঝে কিছু সংখ্যা প্রবেশ করিয়ে ইমতিয়াজ আহমেদের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, প্রায় তের ট্রিলিয়ন ডলারের মার্কেট!
তের ট্রিলিয়ন ডলার! ইমতিয়াজ আহমেদ জিভ দিয়ে এক ধরনের শব্দ করে বললেন, তার যদি দশ পার্সেন্টও আমরা ধরে রাখতে পারি—
জাহিদ হতচকিতের মতো সবার দিকে তাকিয়েছিল, এবারে চিৎকার করে বলল, কখনোই না! কখনোই এটা হতে পারে না।
ইমতিয়াজ আহমেদ ভুরু কুঁচকে জাহিদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন তারপর বললেন, পারে না?
না। আমি এই কোম্পানির একজন কর্মচারী। আমার একটা অধিকার রয়েছে।
ইমতিয়াজ আহমেদ জাহিদের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, তোমার কোনো অধিকার নেই জাহিদ।
কেন নেই!
কারণ তোমাকে আমি বরখাস্ত করলাম। তোমার মতো পাষণ্ডকে কোম্পানিতে রাখা ঠিক না। কী বল তোমরা?
আবদুল্লাহ ছাড়া আর সবাই ঋঞ্জ নেড়ে সম্মতি জানাল।
ভাবনা
আমি একটি চতুর্থ স্তরের রবোট। আমার কপোট্রন কিউ ৪২ ধরনের–এটি গৃহস্থালি কাজে পারদর্শী। আমি এই মুহূর্তে আমার মনিবের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছি, তিনি আমাকে কিছু আদেশ দেবেন এবং তিনি আদেশ দেয়া মাত্র আমি সেই আদেশ পালন করব। আমার কপোট্রন একটি তথ্য সেকেন্ডে একুশ ট্রিলিয়ন বার পর্যালোচনা করতে পারে, সেই তুলনায় আমার মনিব অত্যন্ত ধীরগতিসম্পন্ন। তিনি একজন জৈবিক মানুষ। জৈবিক মানুষের বায়ো যোগাযোগ হয় খুব ধীরে। আমি প্রায় তিন শ মিলি সেকেন্ড ধরে অপেক্ষা করে আছি এবং এই সময়ে প্রায় সাত ট্রিলিয়ন তথ্যকে পর্যালোচনা করে ফেলেছি তবুও তিনি আদেশটি উচ্চারণ করতে পারেন নি। তিনি সেকেন্ডে মাত্র কয়েকটি শব্দ উচ্চারণ করতে পারেন এবং তাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি শেষ পর্যন্ত প্রথম শব্দটি উচ্চারণ করতে শুরু করেছেন। আমি আমার শব্দগ্রাহক যন্ত্রকে তীক্ষ্ণ করে এনেছি প্রত্যেকটি শব্দকে যেন নির্ভুলভাবে শুনতে পারি।